সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া শুধু আইনি নয়, ধর্মীয় দায়িত্বও বটে
২২ অক্টোবর ২০২১ ১০:১১
ঢাকা: সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের (হিন্দু সম্প্রদায়ের) বাড়িঘর, পূজামণ্ডপ ও তাদের জান-মালের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য নতুন করে আইন প্রণয়ন করা কতটা প্রয়োজন। সেসব বিষয়েই বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা সারাবাংলার সাপ্তাহিক আইনি পরামর্শ বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘লিগ্যাল চেম্বারস’-পাওয়ার্ড বাই প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইফ্ফাত গিয়াস আরেফিনের পরিকল্পনা ও সঞ্চালনায় এ সপ্তাহের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী শাহ মনজুরুল হক এবং বিশেষ আলোচক হিসেবে ছিলেন যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটি লন্ডনের সহযোগী অধ্যাপক ড. বিদিত দে।
বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) রাতে আলোচনা অনুষ্ঠানটি সারাবাংলার ফেসবুক ও ইউটিউব পেজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সেই আলোচনা অনুষ্ঠানের পরিমার্জিত অনুলিখন পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:
অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক আইনজীবী শাহ মনজুরুল হক বলেন, আমরা অত্যন্ত খারাপ একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে বলছি- গত কয়েকদিনে সারাদেশের ২১টি জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে। এবং এর জন্য সংখ্যালঘুরা বলছেন আর আমরাও বলছি এর একটি আইনি সমাধান দরকার। আমরা যখন ভারতের কাছ থেকে স্বাধীন হলাম। তখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন হয়েছি। সেই দ্বিজাতি তত্ত্বটি যে ভুল ছিল তা প্রমাণিত হলো ১৯৭১ সালে। তখনই বিষয়টি মীমাংসিত হয়ে গিয়েছে যে আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সকল ধর্মের মানুষ এই রাষ্ট্রে নিরাপদ থাকবে, সংবিধান সে নিশ্চয়তা দিয়েছে। স্বাধীনতার মুল ভিত্তি সেটাই ছিল।
বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এবং সকল ধর্মের মানুষ এখানে নিরাপদ থাকবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম সবার রক্তের বিনিময়েই কিন্তু আমাদের আজকের বাংলাদেশ। সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ দেশের জন্য যুদ্ধ করে এদেশকে স্বাধীন করেছেন এবং সবার নিরাপত্তা সংবিধানে প্রদান করা হয়েছে। এখন তাদের (সংখ্যালঘু) জন্য প্রথম বিষয়টি হলো মৌলিক নিরাপত্তা, তারা কখনও বাংলাদেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নন। সংখ্যালঘু যারা আছেন তারা সবাই সম অধিকার সম্পন্ন বাংলাদেশের নাগরিক এবং সবার জন্য আইন বিদ্যমান।
এবারের ঘটনাটি একটু ভিন্ন ধর্মী। পবিত্র কুরআন শরীফ মন্দিরে রাখা হয়েছে। সে ঘটনার পর সারাদেশে সহিংসতা বা সন্ত্রাস চলছে। সরকারের জন্য, সরকারের ভাবমূর্তির জন্য এটি অনেকটাই স্পর্শকাতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন ব্যক্তি অপরাধ করে থাকলে আইন অনুযায়ী ওই ব্যক্তির বিচার হওয়া প্রয়োজন। এখানে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে যারা সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া এবং তাদের ধন সম্পদ নষ্ট করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের অনেক এলাকায় সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় রাত কাটাচ্ছেন। এখন জান-মালের নিরাপত্তা নিয়ে সংখ্যালঘুরা চিন্তিত পড়েছেন।
আমি ইসলাম ধর্মের লোকজনকে বলব, আমরা যারা মুসলিম- আমাদের পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে, আইন ও শরিয়া অনুযায়ী প্রত্যেকটা হিন্দু নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়া। এটা মুসলিমদের নাগরিক দায়িত্ব। কারণ তারা এ রাষ্ট্রের নাগরিক। যারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বিচার হতে হবে।
এই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে এর জন্য তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হতে পারে। যারা এসব কর্মকাণ্ড করেছে তাদের দ্রুত বিচার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। বিদ্যমান আইনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; প্রয়োজনে সন্ত্রাস দমন আইনে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের দ্রুত বিচার সম্পন্ন করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ আলোচক যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটি লন্ডনের সহযোগী অধ্যাপক ড. বিদিত দে বলেন, কুমিল্লায় যে ঘটনাটি ঘটেছে সে বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট ভাববার অবকাশ রয়েছে। কারণ ওই ঘটনার সঙ্গে ইকবাল নামে এক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে যদি ইকবাল নামের মুসলমান একজন না হয়ে দেবাশীষ নামের হিন্দু একজন হতো তাহলে কি মন্দির ভাঙা জায়েজ হতো। হতো না। আমাদের যে বিষয়টি বুঝতে হবে। একটি ধর্ম গ্রন্থ- তার পবিত্রতা, তার পবিত্রতাকে ভূলুণ্ঠিত করা, অবমাননা করার সামর্থ্য কি একজন মানুষের আছে?
একটি ধর্ম গ্রন্থকে কোন এক জায়গায় রাখলেই কি ধর্ম অবমাননা হয়ে যায়? বা এ কি সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যদি দেখি, যে দলটির নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করি ওই দলটির সঙ্গে এখন যারা আছেন, তাদের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে, তারা প্রত্যেকেই ধর্ম নিরপেক্ষ কিন্তু সেই দলটির শাসনামলে আমরা ক্রমাগতভাবে এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছি। যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিগুলোকে আমরা স্পর্শকাতর জায়গায় নিয়ে গেছি। আমরা কখনো সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিক-ভাবে এ বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করিনি। আমাদের দেশে এখন যেকোনো সাম্প্রদায়িক কুটুক্তি, সাম্প্রদায়িক ব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
শাহ মনজুরুল হক আরও বলেন, প্রকৃত ইসলাম কখনো ধর্ম বিদ্বেষী না। যদি কেউ অপরাধ করে থাকে তাহলে ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী বিচার হবে।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য আইন হওয়াটা কতটা প্রয়োজন এই প্রশ্নের জবাবে ড. বিদিত দে বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত কোন ব্যবস্থা নিতে হলে অবশ্যই আইন হওয়া প্রয়োজন।
শাহ মনজুরুল হক বলেন, বর্তমানে সংখ্যালঘুদের ওপর যে ঘটনাগুলো ঘটছে। তা অবশ্যই প্রতিহত করা দরকার। সামাজিকভাবে এবং আইনগতভাবে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। যারাই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিদ্যমান আইনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এবং এ জন্য নতুন করে আইন প্রণয়ন করাও যেতে পারে। এর ফলে সংখ্যালঘুদের ওপর এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে অপরাধীদের মনে ভয় কাজ করবে। একই সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয় করা দরকার। এবং সরকারের পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করাও প্রয়োজন। আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা সম্পর্কে যে আইনি কাঠামো রয়েছে সে বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও প্রয়োজন। আমাদের দেশের প্রত্যেকটি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের আইনি দায়িত্ব নয় ধর্মীয় দায়িত্বও বটে। ভবিষ্যতে যেন এসব ঘটনা আর না ঘটে এবং বর্তমানের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অতি দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার করা উচিত।
সারাবাংলা/কেআইএফ