Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় নতুন আইনের তাগিদ

রাজনীন ফারজানা
২২ অক্টোবর ২০২১ ২১:০৯

সম্প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির-মণ্ডপে হামলা ও তাদের বসতবাড়িতে আগুন দেওয়াসহ লুটপাটের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিরাপত্তায় নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, মানুষের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন একদিনেই সম্ভব না। তাই প্রয়োজনে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় নতুন আইন করা যেতে পারে। তবে কেবল আইন করে নয়, সংখ্যালঘু নির্যাতন দমনে ভিন্ন ধর্ম বা মতাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়াতে সামাজিক, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপরও জোর দেন তারা। আইনজীবীরা বলছেন, ভালোর জন্য করতে বললে মানুষ সবসময় কথা শোনে না, কিন্তু বাধ্য করলে তারা মেনে নেয়। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় প্রতিবছরের মতো আগামী বছরও পূজা মণ্ডপ বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়িতে আক্রমণ ঠেকাতে এখনই নতুন আইন করা দরকার বলে মনে করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা ডটনেটের আইন বিষয়ক আয়োজন সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বার পাওয়ার্ড বাই প্রিমিয়ার ব্যাংক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আইনজীবীরা এই মতামত দেন। ‘সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় আইন’ শিরোনামের ওই অনুষ্ঠানে তারা বলেন, যেহেতু কয়েক বছর ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর চলা ধারাবাহিক নির্যাতনের পরও সেসব ঘটনার বিচার হচ্ছে না, তাই প্রয়োজনে তাদের নিরাপত্তায় নতুন আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফীনের পরিকল্পনা ও সঞ্চালনায় এই আয়োজনের প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক ও বিশেষ আলোচক ছিলেন যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. বিদিত দে।

নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ্‌ মঞ্জুরুল হক বলেন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন আইন করা দরকার। এর জন্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে একটি যথাযথ আইন করতে হবে।

ড. বিদিত বলেন, মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য মাস্ক পরা বা গাড়ি চালানোর সময় সিটবেল্ট পরা উচিত। কিন্তু ভালোভাবে বললে তারা শুনতে চাননি, যতক্ষণ না পর্যন্ত সেটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের দেশে যেহেতু প্রতিবছরই হামলার ঘটনা ঘটে, তাই আগামী বছর এমন হামলা আর না দেখতে চাইলে মানুষকে আইন করে বাধ্য করতে হবে। একইসঙ্গে সামাজিক ও শিক্ষাগত পরিবর্তনের জোর দাবিও তারা তোলেন।

আরও পড়ুন- সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া শুধু আইনি নয়, ধর্মীয় দায়িত্বও বটে

ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশে কালোসহ অশ্বেতাঙ্গদের নিরাপত্তা দিতে বর্ণবাদবিরোধী আইন আছে। যেহেতু দেশে বিদ্যমান আইন সংখ্যালঘুদের সুবিধা দিতে পারছে না, সেক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বিশেষ নিরাপত্তা আইন করা দরকার কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, নতুন আইন প্রয়োজন। একটি আইন প্রণয়নের আগে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। একটি ঘটনা ঘটলেই নতুন আইন লাগবে বিষয়টা তা না। এর জন্য ধর্মতত্ত্ববিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, আইনবিদসহ একটি কমিটি করে নতুন আইন প্রয়োজন কিনা বা থাকলেও সেটি কীভাবে হবে সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। নতুন আইনে বিদ্যমান আইনে যেসব অপরাধের সাজা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, নতুন আইনে সেগুলো আনতে হবে অথবা পুরনো আইনের কিছু কিছু প্রভিশনও চাইলে সংযুক্ত করতে হবে। এই মুহুর্তে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় নতুন আইন দরকার এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে পূজা মণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ব্যাপকহারে সংঘর্ষ শুরু হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, পূজা মণ্ডপ ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এতে একাধিক মৃত্যুও হয়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। অনেকেই ভয়ে ঘর থেকে বের হননি, অংশ নিতে পারেননি দুর্গোৎসবে।

সাম্প্রদায়িক এই পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার। সংবিধানে তাদের ধর্ম, বিশ্বাস, উৎসব ও আচরণের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কয়েক বছর ধরেই দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতনের নানা ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছেন বা দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বিচারপ্রক্রিয়া থমকে থাকায় সহিংসতা ও নির্যাতনে ঘটনা বেড়েই যাচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, ইসলামসহ কোনো ধর্মই মানুষকে নির্যাতনের অধিকার দেয়নি। বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন এবং সবার নিরাপত্তা সংবিধানে প্রদান করা হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নন। এখন তাদের (সংখ্যালঘু) জন্য প্রথম বিষয়টি হলো মৌলিক নিরাপত্তা। সংখ্যালঘু যারা আছেন তারা সবাই সমঅধিকার সম্পন্ন বাংলাদেশের নাগরিক এবং সবাই একই আইনগত সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন।

এক প্রশ্নের জবাবে অভিজ্ঞ এই আইনজীবী আরও বলেন, সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যেসব হামলা হয়েছে, সেগুলো ফৌজদারি অপরাধ। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যেসব সহিংসতা ছড়িয়েছে তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধ। এই দুই আইনেই মামলা হতে পারে। বর্তমান ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নিজে মামলা করতে না চায়, তাহলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করতে পারবে বা এটি আসলে তাদের দায়িত্ব। এজাহারের নিয়ম অনুযায়ী সহিংসতার খবর শুনলে পুলিশ সেটির ভিত্তিতে মামলা করতে পারে।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অর্থাৎ চার্চের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে আসার পর ইউরোপের দেশগুলো জাতি-বর্ণ ও ধর্মভিত্তিক সহিংসতা থেকে বের হয়ে আসে। ধর্মের প্রভাবমুক্ত হওয়ার কারণেই তাদের আজকের এই উন্নত অবস্থা কি না জানতে চাইলে ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. বিদিত বলেন, ইউরোপ আর আমাদের উপমহাদেশের সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞা আলাদা। ইউরোপে সেক্যুলারিজম মানে ধর্ম থেকে রাষ্ট্র ও জীবনকে একবারে আলাদা করে ফেলা। অন্যদিকে আমাদের উপমহাদেশে সেক্যুলারিজম মানে ধরা হয় ধর্ম নিরপেক্ষতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও ইউরোপে চরম আকারের নৃশংসতা ছিল, যা থেকে তারা সরে এসেছে। কিন্তু সেখানে এখনও অনেক ধরনের বর্ণবাদী আচরণ বিরাজমান। তার থেকে বের হওয়ার চেষ্টাও লক্ষণীয়।

তিনি বলেন, সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ডি-কলোনাইজেশন অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী আচরণ বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের দ্বারা কৃষাঙ্গ যুবক হত্যার পর ছড়িয়ে পড়া ব্লাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের ঢেউ যুক্তরাজ্যে এসেও লাগে। লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটির কাস বিজনেস স্কুলের নাম থেকে কাস নামটি বাদ দেওয়া হচ্ছে, কারণ কাস কৃষাঙ্গ দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এভাবে সেখানে শুধু আইন দিয়েই নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা সংস্কারের মাধ্যমে সব মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিতের চেষ্টা চলছে।

এই সহযোগী অধ্যাপক জানান, কালো বা এশিয়দের সঙ্গে সাদাদের পরীক্ষায় প্রাপ্ত গ্রেডের পার্থক্য খুব বেশি হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জবাবদিহি করতে হবে। তারা মনে করছেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় বছরের পর বছর ধরে প্রচার করা হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের জন্য উপকারী। সেই প্রভাবেই আজ হোয়াইট সুপ্রিমেসি বিরাজ করছে সমাজে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাকেই বদলে ফেলার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে সে দেশে। তার সন্তান যুক্তরাজ্যে ধর্মশিক্ষায় একাধিক ধর্ম পড়ার সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু তিনি বাংলাদেশ থেকে শুধুমাত্র হিন্দুধর্ম শিক্ষা পেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, আমাদের ধর্মশিক্ষার মধ্যে থেকে বা না থেকে মানবিক শিক্ষা নিতে হবে যেন সবাই অন্য ধর্মাবলম্বীদের সমানভাবে সম্মান করতে পারে। পাশের দেশ ভারতে কংগ্রেস পঞ্চাশ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেও সে দেশে ঠিকমতো সেক্যুলারিজম প্রচার করতে পারেনি। যার ফল হিসেবে সেখানে এখন চরম মৌলবাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় থেকে ফ্যাসিস্ট আচরণ করছে।

বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বেড়ে চলেছে। বিশ্বের নানা দেশে হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট, আইসিস, আরএসএস এমন বিভিন্ন মৌলবাদী শক্তির উত্থান ও বিভিন্ন সময়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন চোখে পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলোকে কিছুটা অসহায় বা নতজানু আচরণ করতে দেখা যায়। এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি না জানতে চাইলে ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বিদিত বলেন, আজ ইসলামি মৌলবাদীদের দ্বারা যেমন সহিংসতার ভয় আছে, একই ভয় আছে হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের কাছ থেকেও। কিছুদিন আগে একজন এমপি আইসিসের হাতে মারা গেছেন, কয়েক বছর আগে একজন এমপি মারা যান হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের হাতে। এসবই আল্ট্রা রাইট উইং রাজনীতির ফলাফল, যা আশির দশকের রিগ্যান-থ্যাচারের নিও লিবারেলিজম থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। এসবেরই ফলাফল আজকের ব্রেক্সিট, মোদি, ট্রাম্প বা বলসেনারোর ক্ষমতায় থাকা।

তিনি বলেন, সরকার বা প্রশাসন দুর্বল না হলেও এসব চরম ডানপন্থিরা রাজনৈতিক দলের একটি গোষ্ঠীর সহানুভূতি পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশেও আমরা সেই পথেই হাঁটছি কি না সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই শিক্ষক। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের প্রগতিশীল নেতৃত্বের মধ্যেও মৌলবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তি রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে সেটির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অনেককেই দেখা গেছে, হাটহাজারীর হুজুরদের তোয়াজ করেছেন। এসব তোষণের ফলে আফগানিস্তান থেকে তালেবানের পরিবর্তে আমেরিকার সরে আসার মতো পরিণতি আনে কি না সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিনিরা ‘গুড তালেবান’, ‘ব্যাড তালেবান’ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেখা গেল সব তালেবান আসলে একইরকম সহিংস ও মৌলবাদী। বাংলাদেশেও এমন পরিণতি যেন না আসে, তাই এখনই সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান করেন তিনি।

সারাবাংলা/আরএফ/

নতুন আইন সংখ্যালঘুদের নিয়ে আইন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সাম্প্রদায়িকতা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আইন সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর