রেইনট্রি ধর্ষণ মামলা: সর্বোচ্চ সাজা দেখছে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ
২৭ অক্টোবর ২০২১ ০৮:২৭
ঢাকা: রাজধানীর বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের মামলায় আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ ৫ আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা হওয়ার কথা রয়েছে আজ বুধবার (২৭ অক্টোবর)। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের আদালত পাঁচ আসামির উপস্থিততে এই রায় ঘোষণা করবেন।
মামলার বাকি চার আসামি হলেন— সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম এবং সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন।
রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে গত ১২ অক্টোবর এই মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। রায় প্রস্তুত না হওয়ায় এবং বিচারক অসুস্থ থাকায় সেদিন রায়ের তারিখ পিছিয়ে আজকের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
আলোচিত এই মামলায় ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীর পরিবার পাঁচ আসামির সর্বোচ্চ সাজার দাবি জানিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষও বলছে, তারা আসামিদের অপরাধ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রপক্ষও আশা করছে, আদালত আসামিদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজা দেবেন। তবে মামলাটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি বলে তারা খালাস পাবেন বলে আশা করছে আসামিপক্ষ।
মামলার বাদী এক তরুণীর মা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ন্যায় বিচার চাই। এ ঘটনার পর আমাদের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। হাতে প্রাণ নিয়ে আদালতে সাক্ষী দিতে গিয়েছি। অনেক কঠিন সময় পার করেছি। এখন ন্যায় বিচারের আশায় আছি। আসামিদের যেন সর্বোচ্চ সাজা (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড) হয়। আমরা দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই যেন ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়।’
সংশ্লিষ্ট আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আফরোজা ফারহানা আহমেদ (অরেঞ্জ) সারাবাংলাকে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। যেহেতু মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনের আগে দায়ের করা, সে কারণে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবনের বিধান রয়েছে। আমরা রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন প্রত্যাশা করছি।
এই আইনজীবী আরও বলেন, মামলাটির বিচার আরও আগেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু সাক্ষীরা আদালতে হাজির না হওয়ায় বিচার শেষ হয়নি। মাঝে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরস্থিতির কারণে আদালত সাধারণ ছুটিতে থাকায় বিচার কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল। তবে আশা করছি, বুধবারই মামলাটি শেষ হবে।
একই ধরনের রায়ের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদও। তিনি বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি, তারা অপরাধী। আশা করছি আদালত আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড) দেবেন।
তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী হেমায়েত উদ্দিন মোল্যা এখনো বলছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। তিনি বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়। কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ডাক্তারি পরীক্ষাতেও আসামিদের বিরুদ্ধে ৯ (১) ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ডাক্তার নিজেই সাক্ষ্যে এটি বলে গেছেন। আমরা আসামিদের নিরাপরাধ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আশা করছি, তারা খালাস ও ন্যায় বিচার পাবেন।
আসামি নাঈম আশরাফের আইনজীবী এ বি এম খায়রুল ইসলাম লিটন বলেন, মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কাগজে-কলমে ধর্ষণ আছে, বাস্তবে নেই। একজন বাদী বলেছেন তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তখন আরেক বাদী বলেছেন তাকেও ধর্ষণ করা হয়েছে। অথচ ডাক্তার বলছেন, ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। ডিএনএতে আলামত নেই। আসামিদের ভয়ভীতি, মারধরের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। তারপরও অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় আশা করছি আসামিরা খালাস পাবেন।
এর আগে, গত ৩ অক্টোবর এই মামলায় রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। ওই দিন পাঁচ আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে মামলাটির রায় ঘোষণার জন্য ১২ অক্টোবর দিন ঠিক করে দেন।
মামলাটির বিচারকাজে এর আগের ধাপে গত ২৯ আগস্ট আত্মপক্ষ শুনানিতে সাফাতসহ পাঁচ আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেন। গত ২২ আগস্ট মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। চার্জশিটভুক্ত ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, বাদী দুই তরুণী আসামি সাদমান সাকিফের পূর্বপরিচিত। তার মাধ্যমেই তাদের পরিচয় হয় আরেক আসামি সাফাতের সঙ্গে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে দুই বান্ধবীকে ডেকে নেওয়া হয় হোটেল রেইনট্রিতে। সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী রহমত তাদের গাড়িতে করে বনানী ২৭ নম্বর বোডের রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যান।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, হোটেলে রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আসামিরা মামলার বাদী এবং তার বান্ধবী ও বন্ধুকে আটকে রাখেন। অস্ত্র দিয়ে তাদের ভয়-ভীতি দেখানো হয়, অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। আসামিরা বাদী ও তার বান্ধবীকে জোর করে একটি হোটেলের একটি রুমে নিয়ে আটকে রাখেন। সেখানে বাদী ও তার বান্ধবীকে সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করেন। ওই ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন এক শিক্ষার্থী।
২০১৭ সালের ৭ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
অভিযোগপত্রে আসামি সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিমের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। বাকি তিন আসামি সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে একই আইনের ৩০ ধারায় ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ করা হয়েছে। পরে ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই একই আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
সারাবাংলা/এআই/টিআর