৪২ বছরের ফেরি আমানত শাহ ছিল ফিটনেসবিহীন
২৮ অক্টোবর ২০২১ ১১:৫৪
মানিকগঞ্জ: রো রো ফেরি আমানত শাহ। বয়স ৪২ বছর। ১৯৭৯ সালে আরিচা ফেরি সেক্টরে যুক্ত হয় এটি। বয়সের ভারে অসুস্থ্য এই ফেরিটিকে প্রায়ই মেরামতের জন্য নেওয়া হতো নারাণগঞ্জের ডকইয়ার্ডে। ফিটনেস না থাকায় পদ্মার তীব্র স্রোতের বিপরীতে ফেরিটি চলতে হিমসিম খেতো। তারপরও দীর্ঘ পুরাতন ও লক্কর ঝক্কর এই ফেরিটি দিয়ে যানবাহন ও যাত্রী পারাপার করা হচ্ছিল। চারমাস আগে ফেরিটি নারাণগঞ্জ থেকে বড় ধরনের মেরামত শেষে পাটুরিয়া ফেরি সেক্টরে নিয়ে আসা হয়। তবে সম্প্রতি ফেরিটি তলদেশে একটি ফুটো হওয়ার তথ্যও রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোর) ফেরি আমানত শাহ’র মাস্টার শরিফুল ইসলাম লিটন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, গতকাল বুধবার টিপ নিয়ে দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া গিয়ে ভাসমান কারখানা মধুমতিতে ফেরিটি মেরামত করার কথা ছিল। কিন্ত তার আগেই ঘটে গেল এই দুর্ঘটনা। সকালে দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়ার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর মাঝ নদী পার হওয়ার পর ফেরিতে পানি ওঠার বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। পরে ভালোভাবেই ফেরিটি পাটুরিয়া ঘাটে নোঙর করেন তিনি। এরপর যানবাহন আনলোড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরিটি এক পাশে কাত হয়ে ডুবে যায়।
দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া খুলনা থেকে ছেড়ে আসা কাভার্ডভ্যান চালক আসলাম ও তার সহযোগী প্রবীর বলেন, ‘আমরা গাড়িতেই ছিলাম। কয়েকজনকে বলতে শুনেছি ফেরিতে পানি উঠছে। নদীতে স্রোত থাকলে ফেরিতে পানি উঠে এটা সব সময় দেখি, এ জন্য গুরুত্ব দেই নাই। যখন ফেরি পাড়ে ভিড়ল তখন দুমড়ে মুড়চে একটা গাড়ি আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছিল। তখন গাড়ি থেকে নেমে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করি, ঝাঁপ দেওয়ার পর ফেরি উল্টা হয়ে দেখি আমার উপরই আসছে। তখন মনে করছি আর বাচুম (বাঁচবো) না। কয়েকবার দম আটকে গেছে, ডুবে যাওয়া গাড়ির সঙ্গে জোরে জোরে অনেক ধাক্কা খেয়েছি। তারপর নদী থেকে তীরে উঠি।’
এদিকে বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স উপসহকারী পরিচালক মো.শরিফুল ইসলাম জানান, তাদের দুটি টিম উদ্ধার কাজ করছে। ঢাকা থেকে ৩টি টিমসহ মোট ৫টি টিম উদ্ধার কাজ পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) এজিএম (মেরিন) আব্দুস সাত্তার জানিয়েছেন, ৪২ বছর আগের ফেরি আমানত শাহ দীর্ঘদিন ধরে ফিটনেসবিহীন ভাবে চলছিল। এ বিষয়ে আবেদনও করা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসি’র আরিচা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান জানান, আমানত শাহ ১৯৭৯ সালে ফেরি বহরে যুক্ত হয়। ফেরিটি কোনো ত্রুটি ছিল কি না তা জানা নেই। তবে ডুবে যাওয়ার প্রাথমিক যে তথ্য পাওয়া গেছে। তাতে মনে হচ্ছে ফেরির তলদেশ ছিদ্র হয়ে পানি উঠে ফেরিটি ডুবে গেছে। আমাদের দেশে ফেরি ডুবির ঘটনা এটাই প্রথম।
এদিকে বুধবার ফেরি ডুবির ঘটনার পর থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ৪টি ট্রাক ও ১টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে। পরে রাত ৮টার পর উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা উদ্ধার তৎপরতা বন্ধ রাখে। আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল ৯টার দিকে পুনরায় উদ্ধার কাজ শুরু করে। এছাড়া উদ্ধার কাজে যোগ দিতে মুন্সিগঞ্জ থেকে উদ্ধাকারী জাহাজ প্রত্যয় রাতে পাটুরিয়া ঘাটে আসার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি।
উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার কমান্ডার এস এম ছানোয়ার হোসেন বলেন, ফেরিটির পাটাতন ফেটে পানি ওঠায় এটি ডুবে যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফেরি আমানত শাহ’র যে ওজন তাতে কোনো কুল কিনারা পাবেনা উদ্ধারকারী জাহাজটি। ফেরির অবকাঠামোর ওজন সম্পর্কে জানা গেছে, ১ হাজার টন। সেক্ষেত্রে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার উদ্ধারে সক্ষমতা মাত্র ৬০ টন। আরেকটি উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় যার উদ্ধারের সক্ষমতা রয়েছে ২৫০ টন। সবমিলিয়ে হাজার টন ওজনের ফেরি আমানত শাহ উদ্ধারে প্রত্যয়ও কোনো কাজে আসবে না।
ফেরি আমানত শাহ ডুবির ঘটনায় নৌমন্ত্রণালয় ও মানিকগগঞ্জ জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার সাবেক নৌ মন্ত্রী শাহজাহান খান দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি ডুবির ঘটনায় নৌ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সুলতান আব্দুল হামিদকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটির গঠন করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ জানান, ফেরি ডুবির ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সানোয়ারুল হককে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ কার্যদিবসে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সারাবাংলা/এনএস