Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাম্প্রদায়িকতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চান অনুপম সেন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৮ অক্টোবর ২০২১ ১৮:৫০

সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন ড. অনুপম সেন

চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে ‘সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার সমাবেশ’ হয়েছে, যাতে একমঞ্চে এসে ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা। সমাবেশে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ড. অনুপম সেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রেখে আইন প্রণয়নের দাবি করেছেন।

বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর নন্দনকাননে সড়ক বন্ধ করে এ সমাবেশের আয়োজন করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সংগঠন ‘ইসকন’। সমাবেশের কারণে আশপাশের এলাকায় চারঘণ্টারও বেশিসময় ধরে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। সমাবেশ শেষে নন্দনকানন থেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব পর্যন্ত পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রধান অতিথির বক্তব্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী অনুপম সেন বলেন, ‘এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা আজ নতুন নয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সাল থেকে এই চেষ্টা হয়ে আসছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি স্বাধীনতার পর থেকেই হিন্দু-মুসলিম অনৈক্য ঘটানোর জন্য সজাগ আছে। স্বাধীনতার পর থেকেই তারা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা বিলুপ্ত করার জন্য, হিন্দুদের দেশ থেকে তাড়ানোর ষড়যন্ত্র করে আসছে। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিনই রেডিও থেকে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সালের নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি অসাধারণ সংবিধান দিয়েছিলেন। চারটি স্তম্ভের ওপর সেই সংবিধান হয়েছিল। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধু অনেককে সুযোগ দিয়েছিলেন। সেই সুযোগ নিয়ে ১৯৭২ সালে এখানে নানা পত্রিকা বের হয়। ভাসানি সাহেব বের করেন হক কথা পত্রিকা। সেখানে লেখা হতো- বঙ্গবন্ধু ভারতের দালাল, হিন্দুদের দালাল। বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন বলে সেই পত্রিকা নিষিদ্ধ করেননি। গণকণ্ঠ নামে একটি পত্রিকায় বের হয়েছিল, সেখানে বঙ্গবন্ধুকে গালাগালি করা হত। হলিডে নামে একটি পত্রিকা বের হত, সেখানে লেখা হত- বঙ্গবন্ধু ভারতের দালাল, হিন্দুদের দালাল। এসব কথা ভুলে গেলে চলবে না।’

বিজ্ঞাপন

সমাবেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখার বার্তা নিয়ে অনেকেই হাজির হয়েছিলেন বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে

রাষ্ট্রধর্মের মাধ্যমে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে মন্তব্য করে অনুপম সেন বলেন, ‘১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু আমাদের যে অসাধারণ সংবিধান দিয়েছিলেন, তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সেই সংবিধান আমরা অনেকটাই হারিয়েছি। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই সংবিধান অনেকটাই পুনরুদ্ধার করেছেন। কিন্তু এখনও অনেক আওয়ামী লীগ নেতার মনোজগতে দ্রুত পরিবর্তন আনা কঠিন, তারা ধীরে চলতে চান। কিন্তু আমরা তা চাই না। আমরা চাই, আজ থেকে এদেশের মানুষকে সমান অধিকার দিতে হবে।’

‘যারা সাম্প্রদায়িক অপরাধ করবে, তাদের ট্রাইব্যুনাল করে দ্রুত বিচার করতে হবে। আইনের মাধ্যমে এমন শাস্তি দিতে হবে, যাতে মানুষ মনে রাখে। এসিড নিক্ষেপের বিরুদ্ধে দেশে মৃত্যুদণ্ডের আইন হয়েছে। এরপর এসিড নিক্ষেপ বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ‍মৃত্যুদণ্ড চাই। যারা হামলার সঙ্গে জড়িত শুধু তাদের নয়, যারা হামলার চক্রান্ত করেছে তাদেরও চাই। সামান্য কথা বললে, আইসিটি আইনে যাকে তাকে গ্রেফতার করা হয়, আমরা ব্লাসফেমির মতো কোনো আইন চাই না। আমরা আইসিটি আইনের পরিবর্তন চাই।’

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যতদিন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন, এ দেশের হিন্দুরা তাদের অভাব-অভিযোগ জানাতে পারবেন। কিন্তু যেদিন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকবেন না, সেদিন কোনো প্রতিবাদও করতে পারবেন না। জিয়াউর রহমানের সময়, বিএনপির সময় হিন্দুরা মাঠে কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ভোলা-বরিশালসহ সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন হয়েছিল, সেদিন আমাদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে দেওয়া হয়নি। এবারের যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত, চট্টগ্রামে এবং বিশেষভাবে নোয়াখালীতে পুলিশ প্রশাসনকে আমরা পাইনি, তাদের ডাকা স্বত্ত্বেও তারা আসেনি, তাদের ভূমিকা দুঃখজনক।’

‘আমাদের নিজেদের রক্ষার জন্য নিজেদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা জয়ী হবো। আমরা কোনোদিন হারবো না। আমরা কিছুদিন আগেও ৯ পারসেন্ট ছিলাম, এখন আমরা ১০ পারসেন্ট হয়েছি। আমরা এদেশ ছাড়ব না। আমরা এদেশের মাটিতে থেকেই সংগ্রাম অব্যাহত রাখব,— বলেন অনুপম সেন।

ইসকন-বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র দাশের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন- হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, উত্তর জেলার সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ পালিত, নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, নগর বিএনপির আহবায়ক শাহাদাত হোসেন, জাসদ নেতা ইন্দুনন্দন দত্ত, ইসকন-চট্টগ্রামের সম্পাদক চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ, সনাতন ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের মধ্যে তপন কান্তি দাশ, চন্দন তালুকদার, আশীষ ভট্টাচার্য, প্রবীর কুমার সেন, চবির সাবেক অধ্যাপক জীনবোধি ভিক্ষু, চসিকের কাউন্সিলর রুমকি সেনগুপ্ত, যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এবং সাংবাদিক মাসুদুল হক।

সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার সমাবেশ থেকে সবাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখার প্রত্যয় জানান

সমাবেশে মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সারাদেশে যে হামলা হয়েছে এটা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত নয়, এটা আওয়ামী লীগের ওপর আঘাত, সরকারের ওপর আঘাত। দুষ্কৃতিকারীদের কোনো ধর্মপরিচয় নেই, সন্ত্রাসী হিসেবে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। যারা পূজামণ্ডপে কোরআন রেখেছে তারা ধর্মান্ধ নয়, ধর্মভীরুও নয়, তারা ধর্মের নাম ব্যবহারকারী দুষ্কৃতিকারী।’

এম এ সালাম বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সংখ্যালঘু শব্দটা ‍মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। বাংলাদেশের মালিক সবধর্মের মানুষ। এখানে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বলতে কিছু নেই। একটা জিনিস বুঝতে হবে- ধর্মের কোনো দেশ নেই, ধর্মের কোনো সীমানা নেই। সুতরাং কারও ধর্মপালনে বাধা দেওয়া যাবে না।’

বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন সমবেতদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার দল বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে একজন মুসলমান, খ্রিস্টানের, বৌদ্ধের যে অধিকার আপনাদেরও একই অধিকার। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সমান নিরাপত্তা পাবার অধিকার আপনাদের আছে। আমরা সাম্যের কথা বলতে চাই, যে কথা কবিরা তাদের কবিতায় বলে গেছেন। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা সন্ত্রাস চাই না। বিএনপি আপনাদের পাশে অতীতে যেমন ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘হামলার ঘটনার সাথে যারা জড়িত, বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি দিতে হবে। অনর্থক লোক ধরে এনে লোক দেখানো বিচার আমরা চাই না। জেলে বন্দি লোকজনকে আসামি করা হোক, সেটা আমরা চাই না। যারা প্রকৃত দোষী তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। সাতদিন পর সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ হয়েছে, কেন প্রথমদিন সেটা প্রকাশ করা হল না, আমরা সেটা জানতে চাই।’

সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের কষ্ট, ক্ষোভ, হতাশা, অভিমানের সঙ্গে আমরা একমত। কিন্তু প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানালে কেউ সুযোগ পাবে কি না সেটাও ভেবে দেখতে হবে। অনেকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য বসে আছে। এটা সত্য যে, এদেশ থেকে জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ নির্মূল করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। এই মুহুর্তে দেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প কেউ আছে কি না সেটা ভেবে দেখতে হবে। সবাইকে ধৈয্র্য ধরতে হবে। আমরা মুসলমান হতে পারি, কিন্তু সবধর্মের মানুষের অধিকারের পক্ষে আমরা একমত।’

মফিজুর রহমান বলেন, ‘স্বৈরাচার এরশাদ এদেশে একটি ঘৃণ্য কাজ করে গেছেন। তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছেন। অথচ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই। যারা পবিত্র কোরআন শরীফকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে গুজব ছড়িয়ে ঘৃণ্য হামলা করেছে, তাদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার দাবি করছি।’

ইসকন-বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র দাশ বলেন, ‘একাত্তর পরবর্তী এদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার কোনো বিচার হয়নি। একজনের যদি বিচার হতো তাহলে সবাই ভয় পেত, আর একটা করত না। নোয়াখালীর ইসকন মন্দিরে হামলার পর আমরা সবাই এক হয়ে মাঠে নেমেছি। আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। অনেক প্রগতিশীল মানুষ আজ আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। এখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও এসেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের মা। তিনি আমাদের ডাকুক। আমাদের দাবিগুলো আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চাই। যদি দাবি মানা না হয়, আমরা রাজপথ ছাড়ব না। চট্টগ্রামে সমাবেশ হয়েছে। সব বিভাগীয় শহরে সমাবেশ দেব। চট্টগ্রামে ৫০-৬০ হাজার মানুষ হয়েছে। ঢাকায় দেব, লাখ লাখ মানুষ হবে।’

প্রশাসনের গাফেলতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নোয়াখালীর চৌমুহনীতে ফোন করেও পুলিশ পাওয়া যায়নি। আমাদের মনে হয়, প্রশাসনের মধ্যে তারা ঘাপটি মেরে আছে। পরে এসে বলছে- বিএনপি জামায়াত এটা করেছে। আমরা বলেছি যে-ই করুক, শনাক্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। নোয়াখালীর ঘটনাটি পরিকল্পিত। কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছিল না। তাহলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কী কাজ?’

সারাবাংলা/আরডি/একে

সাম্প্রদায়িক হামলা হামলা মোকাবিলা হিন্দু ধর্মাবলম্বী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর