মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় সার বিক্রিতে কৃষকদের সঙ্গে চলছে ‘ডাকাতি’। সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে টিএসপি সারের দাম হাঁকানো হচ্ছে বস্তা প্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেশি। পাশাপাশি ইউরিয়া, পটাশ ও ডিএপি সার বেচাকেনাতেও নেওয়া হচ্ছে বাড়তি টাকা। কৃষকদের অভিযোগ, বাড়তি টাকায় সার পাওয়া গেলেও সরকার নির্ধারিত দামে সার পাওয়া দুস্কর। এমন চিত্র দেখা গেলো ঐহিত্যবাহী শিবালয় উপজেলার বরংগাইল হাটে।
সরজমিনে বংরগাইল হাটে দেখা যায়, হাটের তিন জন সারের ডিলার প্রকাশ্যেই কৃষকদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে সার বিক্রি করছে। এই হাটের তেমন এক সাব ডিলার মেসার্স নিজাম বীজ ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী মো. নিজাম উদ্দিন। সব সময়ই কৃষকের ভিড় থাকে তার দোকানে। মো. নিজাম উদ্দিন মহাবেদপুর ইউনিয়নের সাব ডিলার। বেশি দামে সার বেচা কেনার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন তিনিই।
ইউরিয়া, পটাশ ও ডিএপি সার প্রতি বস্তা সরকার নির্ধারিত দাম থেকে অল্প কিছু টাকা বেশি বিক্রি করলেও মূলত টিএসপি সার বিক্রিতে বস্তা প্রতি টিএসপি সার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি নিচ্ছেন। যেখানে সরকার ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা টিএসপি সার নির্ধারণ করে দিয়েছে ১১০০ টাকা। বেশি দামে সার বেচা কেনার ফলে কৃষকদের কাছে বিক্রিত সারের কোনো রশিদও দেওয়া হচ্ছে না।
বরংগাইল হাটে সরকারের তালিকাভুক্ত তিনটি সারের দোকানে সোমবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বাজার মনিটরিংয়ে দেখা যায়নি কোনো কৃষি অফিসারকে। এ নিয়েও কৃষকদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
কথা হয় মো. নিজাম উদ্দিনের দোকানে সার নিতে আসা কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। শিবালয় উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের লক্ষীপুরা গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দুই বস্তা টিএসপি সার নিয়েছি ২৭০০ টাকা দিয়ে। এক বস্তার দাম পড়েছে সাড়ে ১৩০০ টাকা। অথচ সরকারি রেট প্রতি বস্তা ১১০০ টাকা। দুই বস্তা সারে আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকা বেশি নিয়েছে।’
একই গ্রামের কৃষক মো. আলমাছ মিয়া বলেন, ‘জমি থেকে পানি নেমে গেছে, এখন ফসল আবাদ করতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে ১১০০ টাকা বস্তার টিএসপি নিলাম ১৩৫০ টাকায় আর ৭৫০ টাকা বস্তার পটাশ নিলাম ৯০০ টাকা দিয়ে। সব মিলে ১০ বস্তা সার নিয়েছি। ইচ্ছেমতো এভাবে সারের দাম বাড়ানো হলে কৃষক কোথায় যাবে।’
উপজেলার ডাকিজোড়া তাড়াইল গ্রামের কৃষক মো. লিটন মিয়া বলেন, ‘পেঁয়াজ ও রসুন আবাদের জন্য আমার ক্ষেতে প্রস্তত করা হয়েছে। এখন জমিতে সার দিতে হবে, তাই এক বস্তা টিএসপি ১৩৫০ টাকায় নিয়ে গেলাম। দাম বেশি না দিলে সার পাওয়া যায় না। কি আর করার ফসল তো বুনতে হবে।’
ঘিওর উপজেলার পুখুরিয়া গ্রামের কৃষক রজ্জব আলী বলেন, ‘নিজ গ্রাম পুখুরিয়া বাজারে সারের দোকানে টিএসপি সার কিনতে গেলে বস্তা প্রতি ১৪০০ টাকা চেয়েছে। তাই বরংগাইল হাটের নিজাম বীজ ভাণ্ডারে দাম যাচাই করতে এসেছি। এখানেও একই দামে সার বেচাকেনা হচ্ছে। আমার মোট ২০ বস্তা সার প্রয়োজন। এক বস্তা সারে যদি ৩০০-৪০০ টাকা বেশি লাগে তাহলে ২০ বস্তায় আমার কত টাকা লাগবে আপনারাই বলুন? এই অনিয়ম, কৃষকদের সঙ্গে অন্যায় করা ছাড়া আর কিছুই না।’
শিমুলিয়া ইউনিয়নের কাছিধারা গ্রামের কৃষক জামাল খান বলেন, দুই বস্তা পটাশ সারের জন্য বরংগাইল হাটের সাব ডিলার নিজামের দোকানে গেলে সংকট দেখিয়ে আমাকে সার দেয়নি। আসলে সাংবাদিকদের সামনে দাম বেশি চাইতে না পারায় আমাকে সে বলেছে পটাশ সার নেই।
দেখা যায় সাংবাদিকরা যখন বরাংগাইল হাটে সারের দাম নিয়ে ডিলার এবং সাব ডিলারের সঙ্গে কথা বলতে চায় তখন শুরু হয় নানা তালবাহানা। সাব-ডিলার নিজাম উদ্দিন সাংবাদিক দেখা মাত্র কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠেন। এসময় তিনি সারের দাম বেশি নেওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেন। পাশাপাশি কৃষকদের সাফ সাফ জানিয়ে দেন কৃষি কার্ড এবং ভোটার আইডি কার্ড ছাড়া এখন থেকে এক কেজি সারও বিক্রি হবে না।
সার বেচাকেনায় অনিয়ম নিয়ে সাব ডিলার নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘টিএসপি সার সংকট হওয়ায় সেই সার বাড়তি টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। তাই বাধ্য হয়ে দাম বেশি নিতে হচ্ছে। এক বস্তা টিএসপি সার বিক্রি করছি ১৩৫০ টাকা।’
সরকারি রেট ১১০০ টাকা, আপনি কেনো বেশি নিচ্ছেন এমন প্রশ্ন করা হলে নিজাম উদ্দিন বলেন, “ডিও’র মালামাল না থাকায় আমরা নারায়নগঞ্জ থেকে বেশি টাকা দিয়ে টিএসপি সার আনার কারণেই দাম বেশি নিতে হচ্ছে।”
শিবালয় উপ-সহকারী কৃষি অফিসার (বরংগাইল ব্লক) মো. সাজ্জাত হোসেন বলেন, ‘সারের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে কিনা এ নিয়ে প্রতিদিনই বাজার মনিটরিং করা হয়। তবে সোমবার প্রশিক্ষণ থাকায় বরংগাইলে যেতে পারিনি। লালসালু কাপড়ে লেখা সারের দামের তালিকা প্রতিটি ডিলার ও সাব ডিলারের দোকানে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি নিজে কৃষককে বলেছি সঠিক দাম দিয়ে সার কিনতে।’
শিবালয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.রিয়াজুর রহমান বলেন, ‘সারের দাম নিয়ে এর আগে কয়েকজন কৃষক আমাকে অবগত করেছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে আমি সেই সাব ডিলারদের সতর্ক করে দিয়েছিলাম। এখন যদি কোনো ডিলারের বিরুদ্ধে সারের দাম নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পাই সেক্ষেত্রে আমি কঠোর ব্যবস্থা নেবো। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট চালানো হবে।’
সার সংকট আছে কিনা সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ডিলার ও সাব ডিলারের কাছে আমাদের অফিসার পাঠিয়েছিলাম। তথ্য অনুযায়ী ডিলার ও সাব ডিলারের কাছে যথেষ্ট পরিমান সার রয়েছে। কেউ যদি সংকটের কথা বলে সেক্ষেত্রে কাগজপত্র ঘাটলেই বেরিয়ে আসবে সংকট আছে কিনা। আর যদি কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কৃষি কার্ড দিয়ে সার নেওয়ার কোন বিধান আছে কিনা সে সম্পর্কে কৃষি কর্মকর্তা রিয়াজুর রহমান বলেন, ‘এ নিয়ম ত্ববধায়ক সরকারের সময় ছিল। সেটা এখন নেই। তাছাড়া এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোনো নির্দেশনা নেই যে, সার পেতে কৃষি কার্ড লাগবে।’