গুগল,ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ
২৯ অক্টোবর ২০২১ ০৯:৩৩
ঢাকা: গুগল-ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, অ্যামাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত অর্থ থেকে ট্যাক্স, ভ্যাট এবং অন্যান্য রাজস্ব আদায় করতে সরকারের সাত মন্ত্রণালয়-সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
গত বছরের ৮ নভেম্বর এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ আদেশে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল এবং বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের রায়ের ১৪৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী হুমায়ন কবির পল্লব। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের ওয়ায়েস আল হারুনী।
রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর আইনজীবী হুমায়ন কবির পল্লব সাংবাদিকদের জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুগল-ফেসবুক এবং অন্যান্য ইন্টারনেট কোম্পানির বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার বিষয় এবং বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে জনস্বার্থে দায়ের করা রিট পিটিশনের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিবাদীদের প্রতি কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
এই রায় দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী রায় বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এর ধারা ৪ অনুযায়ী গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে মূসক নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। এবং দ্য ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ এর ধারা ৭৫ মোতাবেক গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে বাধ্য।
মূল্য সংযোজক কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এবং দ্য ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ আইন অনুযায়ী গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মূসক, টার্নওভার কর ও সম্পূরক শুল্ক, ধারা ১৫ এর অধীন আরোপিত মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর প্রদানসহ সকল ধরনের রাজস্ব প্রদান করছেন না।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিজ্ঞাপন, ডোমেইন বিক্রি, লাইসেন্স ফিসহ সকল প্রকার লেনদেন থেকে উৎসে কর, শুল্কসহ সকল ধরনের রাজস্ব বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য পাওনা।
বাংলাদেশের জনগণের এই ন্যায্য পাওনা গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মূসক, টার্নওভার কর ও সম্পূরক শুল্ক, ধারা ১৫ এর অধীন আরোপীত মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর প্রদানসহ সকল ধরনের রাজস্ব বকেয়াসহ প্রদান করবেন এটি বাংলাদেশের জনগণ আশা করে।
যেহেতু বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবির উপরিল্লিখিত সকল চিঠিপত্র এবং অনলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট ও লেখা পর্যালোচনায় এটা কাঁচের মতো পরিষ্কার যে, গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিজ্ঞাপন, ডোমেইন বিক্রি, লাইসেন্স ফি সহ সকল প্রকার লেনদেন থেকে উৎসে কর, শুল্কসহ সকল ধরনের রাজস্ব প্রদান বাংলাদেশে করছেন না এবং যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাপক পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে এবং যেহেতু গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মূসক, টার্নওভার কর ও সম্পূরক শুল্ক, ধারা ১৫ এর অধীন আরোপিত মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর প্রদান না করা বেআইনি, সেহেতু অত্র রুলটি চূড়ান্ত (যথাযথ ঘোষণা) যোগ্য।
ট্যাক্স, ভ্যাট এবং অন্যান্য রাজস্ব আদায় করতে চার দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেগুলো হলো—
১. গুগল, ফেইসবুক, ইউটিউব, ইয়াছ, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিজ্ঞাপন, ডোমেইন বিক্রি, লাইসেন্স ফিসহ সকল প্রকারলেনদেন থেকে মূসক, টার্নওভার কর ও সম্পূরক শুল্ক, ধারা ১৫ এর অধীন আরোপিত মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর প্রদানসহ সকল ধরনের রাজস্ব আদায় করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআরের চেয়ারম্যান, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবের আইনগত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
২. গুগল, ফেইসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিজ্ঞাপন, ডোমেইন বিক্রি, লাইসেন্স ফি সহ সকল প্রকার লেনদেন থেকে মূসক, টার্নওভার কর ও সম্পূরক শুল্ক, ধারা ১৫ এর অধীন আরোপিত মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর প্রদানসহ সকল ধরনের রাজস্ব আদায় করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সাত দফতরের প্রতি এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
৩. গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিজ্ঞাপন, ডোমেইন বিক্রি, লাইসেন্স ফি সহ সকল প্রকার লেনদেন থেকে মূসক, টার্নওভার কর ও সম্পূরক শুল্ক, ধারা ১৫ এর অধীন আরোপিত মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর প্রদানসহ সকল ধরনের বকেয়া রাজস্ব আদায় করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সাত দফতরের প্রতি এ আদেশ দেওয়া হয়েছে।
৪. ছয় মাস অন্তর অন্তর গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইয়াহু, আমাজনসহ অন্যান্য ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিজ্ঞাপন, ডোমেইন বিক্রি, লাইসেন্স ফি সহ সকল প্রকার লেনদেন থেকে মূসক, টার্নওভার কর ও সম্পূরক শুল্ক, ধারা ১৫ এর অধীন আরোপিত মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর প্রদানসহ সকল ধরনের বকেয়া-রাজস্ব আদায়ের বিবরণী হলফনামা আকারে আদালতে দাখিল করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ প্রদান করা হয়।
এই মামলাটি একটি চলমান আদেশ হিসেবে অব্যাহত থাকবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে দরখাস্তকারী ছয় জনকে জাতীয় রাজস্ব রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন আদালত।
২০১৮ সালে একটি পত্রিকার প্রতিবেদন সংযুক্ত করে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে আইনজীবী হুমায়ুন পপকবির পল্লব, মোহাম্মদ কাওছার, মোহাম্মদ মাজেদুল কাদের, মো. সাজ্জাদুল ইসলামসহ ছয় জন আইনজীবী জনস্বার্থে এই রিট দায়ের করেছিলেন। পরে আদালত শুনানি নিয়ে এ বিষয়ে রুল জারি করে।
এরপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৮ নভেম্বর এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এসএসএ