ফেব্রুয়ারিতে সিপিবি’র কংগ্রেস, পরিবর্তন আসছে মূল নেতৃত্বে
৩০ অক্টোবর ২০২১ ১২:০৮
ঢাকা: জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের ১০, ১১, ১২, ১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কংগ্রেস। রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে এই কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। এবারের কংগ্রেস দলটির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন দলীয় নেতাকর্মীরা। এই কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে মুল নেতৃত্বে পরির্বতন আসবে। তবে কে হবেন দলটির কর্ণধার তা এখনও ঠিক হয়নি। প্রতি ৪ বছর পরপর দলটির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, কংগ্রেসে সফল করার জন্য সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির বিরামহীন বৈঠক অব্যাহত রয়েছে। আগামী আরও দুই দিন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। গত অক্টোবরে দলটির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে তা হয়নি।
দলটির নেতাকর্মীরা জানিয়েছে, কংগ্রেস সফল করতে এরইমধ্যে কয়েকটি টিম গঠন করা হয়েছে। সিপিবির শীর্ষ নেতারা প্রতিনিয়ত বৈঠক করছেন। কংগ্রেসের পোস্টার-ফেস্টুন তৈরির কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে। এবারের কংগ্রেসে দেশের বাইরে থেকে সিপিবির কোনো অতিথি অংশগ্রহণ করছেন না। করোনা পরিস্থিতি কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে, এবারের কংগ্রেসে মুল নেতৃত্বে পরির্বতন আসবে। গঠনতন্ত্রে সংশোধনীর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
আগামী ১০ জানুয়ারির মধ্যে জেলা নেতৃবৃন্দসহ দলটির অন্যান্য কমিটির নেতৃবৃন্দ গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনতে পারবেন।
এ সব বিষয় নিয়ে দলটির নেতা কাফি রতন জানান, আগামী ফেব্রুয়ারী মাসে কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এবারের কংগ্রেস খবই গুরুত্ব বহন করবে। কংগ্রেসের মাধ্যমে নেতৃত্বে পরির্বতন এসে থাকে। এবারও তাই হবে।
তিনি জানান, কংগ্রেস সফল করতে বিরামহীন বৈঠক অব্যাহত রয়েছে। বৈঠকে আগামী নির্বাচনের বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করবে কি না সে বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে।
মার্কসবাদী মতবাদভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকারী সংগঠন।
১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর কানপুরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। জন্মলগ্ন থেকেই ভারতে ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির শিকার কমিউনিস্ট পার্টি বেশিরভাগ সময়েই গোপনে কাজ করেছে। ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রথম নিষিদ্ধ করা হয়, যা পরে ১৯৪২ সালে প্রত্যাহার হয়। নিষিদ্ধ অবস্থাতেই পার্টির নেতৃত্বে ১৯৩৯ সালে বোম্বেতে সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী ধর্মঘট সংগঠিত করে। ওই ধর্মঘটে ৯০ হাজার শ্রমিক অংশ নেয়।
চল্লিশের দশকে পার্টি সমগ্র ভারতে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত পার্টির নেতৃত্বে ভারতজুড়ে সংগঠিত হয় তেভাগা, নানকা, টঙ্ক, তেলেঙ্গনা, কেরালায় পুন্নাপা ভায়ালা আন্দোলন ও কায়ুর আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন। ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় ৭ সদস্যের একটি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয়। পরের বছর কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত কাউন্সিলররা ৬ মার্চ পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। একইদিনে পূর্ববঙ্গের কাউন্সিলররা ১৯ সদস্যের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক কমিটি গঠন করেন, যার সম্পাদক নির্বাচিত হন খোকা রায়।
১৯৪৯-৫০ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগ সরকার কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে অবিরাম দমনমূলক ব্যবস্থা চালাতে থাকে। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট বন্দিদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে সাতজন নেতা নিহত এবং ৩১ জন গুরুতর আহত হন। ১৯৫০ সালে রমেন মিত্র ও ইলা মিত্রের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ ও নাচোল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের এবং সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষনেতাদের কারাবন্দি করলে পশ্চিম পাকিস্তানে পার্টির কর্মকাণ্ড প্রায় অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন চলমান থাকে।
৫২-র ভাষা আন্দোলনে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি বিশেষ ভূমিকা রাখে। ’৫৪ সালের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন দেয়। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পার্টি মনোনীত সাত প্রার্থীর মধ্যে চারজন নির্বাচিত হন। একই বছর ৯২-ক ধারা জারি এবং প্রদেশে গভর্নরের শাসন চালু হলে কমিউনিস্ট পার্টি আবার নিষিদ্ধ হয়। এতে পার্টির নেতাকর্মীরা চরম নির্যাতনের মুখে পড়েন।
১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের গণজাগরণ ও অসহযোগ আন্দোলনেও পার্টির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। পার্টির নেতা কমরেড মণি সিংহ প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের সরাসরি পরিচালনায় একটি বিশেষ গেরিলা বাহিনী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্টির নতুন নাম হয় ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে দলের একটি নতুন গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়। কংগ্রেসে মণি সিংহকে সভাপতি ও মোহাম্মদ ফরহাদকে সাধারণ সম্পাদক করে ২৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ করে কমিউনিস্ট পার্টি। ওই সময় পার্টির নেতাকর্মীরা সামরিক সরকারের কঠোর নিপীড়নের শিকার হন। পার্টির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতারা গ্রেফতার হন। অনেকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে কমিউনিস্ট পার্টি ফের নিষিদ্ধ হয়। পরের বছর সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও পার্টির নেতাকর্মীদের মুক্তি দেওয়া হয়।
সিপিবি ১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গঠিত ১৫ দলীয় জোটে যোগ দেয়। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি পাঁচটি আসনে জয়লাভ করে। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বদানে সিপিবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিলোপবাদীরা পার্টি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ১৯৯৩ সালে পার্টির কংগ্রেসে শহীদুল্লাহ চৌধুরীকে সভাপতি এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়।
এরপর ১৯৯৫ সালের ৭-৮ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে ১৭-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেস এবং ২০০৩ সালে অষ্টম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৮ সালের ৭-৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত নবম কংগ্রেসে পার্টির নতুন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। মঞ্জুরুল আহসান খান সভাপতি এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/একে