Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে বিচারহীনতা, রাজনৈতিক প্রশ্রয়’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২ নভেম্বর ২০২১ ০১:৫৫

ঢাকা: দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে বিচাহীনতা ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়কে দায়ী করেছেন মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, কয়েক দশক ধরে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা, নির্যাতন ঘটলেও তার বিচার হয় না। মূল অপরাধী বা ইন্ধনদাতার পরিচয় প্রকাশ বা তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন না করার ফলে বেড়ে চলেছে নির্যাতন। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর দায় স্বীকার না করা ও ক্ষেত্রবিশেষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত রয়েছে বলেও দাবি করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিলে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির নেতারা এসব কথা বলেন। সোমবার (১ নভেম্বর) কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের পাদদেশে এই সমাবেশে অংশ নেয় ৬৮টি নারী অধিকার, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠন।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানিয়ে বক্তারা জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচার দাবি করেন। পাশাপাশি সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেওয়া, বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত যাওয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলসহ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ সব ধরনের বাংলাদেশি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার আহ্বান জানান।

তারা বলেন, পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বারবার দাবি জানানোর পরও তারা সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তারা।

বক্তারা বলেন, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম থাকার কারণে একটি ধর্মের অনুসারীরা বারবার এধরনের ঘটনা ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পাকিস্তানের আদলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কী করলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হবে, তা সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ফলে এই আইন ব্যবহার করে সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ অন্যান্য বিশ্বাসের ব্যক্তিদের হেনস্থা করা হচ্ছে। অথচ ডিজিটাল মাধ্যমে হিংসা ছড়ানো ওয়াজকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, যদিও তাদের বক্তব্যের মাধ্যমেই ধর্মীয় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার অসংখ্য নজির রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানের সভাপতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম কুমিল্লাসহ সম্প্রতি দেশজুড়ে সনাতনধর্মাবলম্বীদের ওপর সংঘটিত সহিংতার ঘটনায় উপযুক্ত বিচার ও পুনরাবৃত্তি না হওয়ার দাবি করেন। তিনি এসময় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা চোখে পড়েছে বলে দাবি করেন ও এ ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের পাশাপাশি অন্য তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করেন।

কুমিল্লার ঘটনায় গ্রেফতার ইকবাল যেন জজ মিয়ার মতো না হয়— এমন আশঙ্কা জানিয়ে ডা. ফওজিয়া বলেন, ‘বিচার চাইতেও ভয় লাগে, যদি এটি জজ মিয়ার মতো কিছু হয়!’ তিনি এসময় এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

মানুষের জন্য ফাউন্ডশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, প্রতিবছরই একই ঘটনা ঘটছে। আর তারপর আমরা অবাক হয়ে যাই। এখন নিজেদেরই প্রশ্ন করার সময় এসেছে— সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা নিজেরা কতটা সোচ্চার?

নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এই সময়ে আজ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ জানাতে হচ্ছে। এটি লজ্জা ও ক্ষোভের। ২০০১ সালের পরে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে এই সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়েছিল। সেই থেকেই তারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদ করে আসছেন, যার ধারাবাহিকতায় আজকের এই আয়োজন।

বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক চৌধুরী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ওয়াজের মাধ্যমে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়। অথচ তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যাবস্থা নেয় না। মাদরাসাগুলো সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর আতুর ঘর। যারা ওয়াজ করে তাদের তো বটেই, মাদরাসাগুলোকেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই— এই দেশ ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবার। যারা এটি মেনে নিতে পারে না, তারা যেন দেশ ছেড়ে পাকিস্তান চলে যায়।

সাম্প্রতিক সহিংসতার সময় প্রসাশনের নিষ্ক্রিয়তা চোখে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু প্রশাসনই নয়, বিচার বিভাগেও রাজাকাররা ঢুকে পড়েছে। এর ফলে আজ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িত কারও বিচার হচ্ছে না এ দেশে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম বলেন, পঁচাত্তরের পরে যে সরকার এসেছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করেছে। সাম্প্রতিক হামলার সময় সংসদ সদস্য, প্রশাসনের গড়িমসি করার অভিযোগ রয়েছে। সরকারের মধ্যে যারা এসব প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, এসব ঘটনায় রাজনীতিবিদদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। দেশ থেকে ধর্মীয় সহিংসতা দূর করতে রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব নিয়ে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, সারাবছর যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশের নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করে, ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রচার করে, নারী ও মুক্ত চিন্তার ব্যক্তিদের ওপর হামলা করে, তখন অনেক রাজনীতিবিদ তাদের সমর্থন ও প্রশ্রয় দেন। তাদের আজ জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে গেছে। এরই ফল সাম্প্রতিক এই সহিংসতা। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আসলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এর বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মকে সোচ্চার হতে হবে।

সাবেক এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আরও বলেন, শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের যেকোনো জায়গায় ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, গণতন্ত্র সংহত না হলে এসব ঘটনা ঘটবেই। কারণ দ্বিমত বা প্রতিবাদ জানানোর কেউ নেই।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, সবার জন্য সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ গড়তে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৮৮ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যোগ করার পর স্বাধীনতার আগের ছাত্র ইউনিয়নের কাজল দেবনাথ, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কাজল হয়ে যান হিন্দু কাজল। আর এই মঞ্চে তিনি উপস্থিত হয়েছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কাজল দেবনাথ হয়ে। এর চেয়ে হতাশার আর কিছু নেই। আমি বলব— রাষ্ট্র যদি চায়, তাহলে এসব ঘটনা (সাম্প্রদায়িক সহিংসতা) ঘটতে পারে না। এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে আর বাংলাদেশ থাকবে কি না, মুজিবের আদর্শ থাকবে কি না— সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।

অনুষ্ঠান শেষে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নিনা গোস্বামী কমিটির পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্র পাঠ করে শোনান। তিনি বলেন, বারবার এই ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পুনরাবৃত্তি রোধে সমাজের মননশীলতা গঠনের ওপর রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও পরিবারকে গুরুত্ব দিতে হবে।

পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা পর্যন্ত মিছিলের মাধ্যমে শেষ হয় এই প্রতিবাদ সমাবেশ। মিছিল ও সমাবেশে বক্তারা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নানা স্লোগান দেন।

সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির ঘোষণাপত্রে ১২ দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে—

১. শারদীয় দুর্গোৎসবে কুমিল্লা, চৌমুহনী, রংপুরের পীরগঞ্জ, চট্টগ্রাম. চাঁদপুরের হাজিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তাদের মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি এসব ঘটনায় অপরাধী ও ইন্ধনদাতাদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে গ্রেফতার ও যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে;

২. সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহীতা ও দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে হবে;

৩. সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে;

৪. ক্ষতিগ্রস্ত সব সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে;

৫. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যেসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, সেসব ঘটনা যথাযথ তদন্ত করে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে;

৬. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করে সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে;

৭. ২০১৩-১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সন্ত্রাসী হামলাকারীদের ট্রাইবুন্যালে দ্রুত বিচারের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে;

৮. রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সম্পূর্ণভাব নিষিদ্ধ করতে হবে;

৯. ধর্মীয় সমাবেশ থেকে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ ও নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে এবং একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ ধরণের অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে;

১০. সব সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থান, সম্প্রীতি, শান্তি, সৌহার্দ্য রক্ষা ও বর্তমান নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে সরকার, প্রশাসন, সব গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি;

১১. দেশের যেকোনো স্থানে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে; এবং

১২. বাত্তরের সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

কাজল দেবনাথ ড. সাদেকা হালিম ডা. ফওজিয়া মোসলেম রাশেদা কে চৌধুরী শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সমাবেশ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

সিটিকে রুখে দিল নিউক্যাসেল
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:০৮

সম্পর্কিত খবর