ক্যালাই জঙ্গল— জীবন, মৃত্যু ও নরকের এক দুয়ার
৩ নভেম্বর ২০২১ ২০:০২
উত্তর ফ্রান্সের ক্যালাই। জঙ্গুলে এক এলাকা। আফ্রিকার ইথিওপিয়া, সুদান, ইরিত্রিসহ নানা দেশ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা ভিড় করেন এই জঙ্গলে। গন্তব্য ফ্রান্স, ইংল্যান্ড অথবা জার্মানি। ২০১৫ সালের সিরিয়ান যুদ্ধের পর ১০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে এসে আশ্রয় নেয় এই এলাকায়। ওই সময় থেকেই মূলত ক্যালাইয়ের এই বনাঞ্চলটি আলোচনায় উঠে আসে। ইউরোপের শরণার্থী সমস্যাটিও প্রকট হয় বিশ্ববাসীর সামনে। ক্যালাই পরিচিত হয়ে ওঠে ‘দ্য জঙ্গল’ নামে।
বছর পাঁচেক আগে এই এলাকায় চালানো হয় উচ্ছেদ অভিযানে। সে অভিযানে জঙ্গলে এসে আশ্রয় নেওয়া বিভিন্ন দেশের শরণার্থীদের সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে না, তাদের সবাইকে একেবারে সরিয়ে দেওয়া যায়নি। থেকে গেছিল কয়েকশ পরিবার। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে— সেই উচ্ছেদের পাঁচ বছর পরেও প্রকৃতি, পুলিশ আর জীবনের সঙ্গে লড়াই করে হাজার দুয়েক শরণার্থী এখনো টিকে আছে উত্তর ফ্রান্সের এই জঙ্গলে। আর পরিমাণে কম হলেও এখনো আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে নতুন শরণার্থীরাও এসে যুক্ত হন তাদের সঙ্গে।
তেমনই নতুন কয়েকজন শরণার্থী এই জঙ্গলে এসে হাজির হন কয়েকদিন আগে। ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া থেকে আসা শরণার্থীদের সবাই পুরুষ। ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে রীতিমতো কাঁপছিলেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই তারা যুক্তরাজ্যে পৌঁছানোর জন্য ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। পথে নৌকার মোটর নষ্ট হয়ে গেলে বিপদে পড়ে যান। শেষমেষ বাকি পথ সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন তারা। সে অবস্থায় কোস্ট গার্ডের সহায়তা চেয়েও পাননি। ফরাসি কোস্ট গার্ডের সদস্যরা দেখিয়ে দেন ইংলিশ কোস্ট গার্ডকে। সাড়া দেয়নি তারাও। পরে ফরাসি কোস্ট গার্ডের সদস্যরাই অবশ্য তাদের উদ্ধার করে ক্যালাইয়ে ফেরত নিয়ে যান।
এমনই একজন শরণার্থী বলছিলেন যুক্তরাজ্যে নতুন জীবন শুরুর স্বপ্নের কথা। নিজ দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে যুক্তরাজ্যে কাজ করতে চান তিনি। কিন্তু ক্যালাইয়ের এই শরণার্থী শিবিরে আটকে পড়ে না আছে সামনে যাওয়ার পথ, না আছে পেছনে ফেরার। ক্রমাগত বর্ণবিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন। জীবনে এখন একমাত্র চাওয়া, শান্তিতে বেঁচে থাকা। কিন্তু সেটিই যেন সবচেয়ে কঠিন এখন।
পাঁচ বছর আগের এই সময়ে ‘দ্য জঙ্গল’-এর অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলেও সেই চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি। অসহায় শরণার্থীদের অনেকেই বিভিন্ন কৌশলে থেকে যেতে পেরেছিলেন। স্থানীয় বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, এখনো সেখানে প্রায় হাজার দুয়েক শরণার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে অভিভাবকহীন ৩০০ শিশুও। ক্যালাই ও এর আশপাশে গাছপালাঘেরা এলাকা, অব্যবহৃত গুদাম ঘর ও বিভিন্ন ব্রিজের নিচে এসব শরণার্থীরা বসবাস করছে। ক্যালাই ছাড়াও উত্তর ফ্রান্সেরই আরেক এলাকা ডানকার্কের পাশের বনেও রয়েছে আরও কয়েশ শরণার্থী।
এসব এলাকায় অপেক্ষমাণ এই অভিবাসীরা রয়েছে রাজনৈতিক ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে। যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের কঠোর জাতীয়তা এবং সীমান্ত বিল এসব শরণার্থীদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। এই বিলের মাধ্যমে ছোট ছোট নৌকায় করে চ্যানেল অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে আশ্রয়প্রার্থীদের কারাদণ্ড এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলপ্রাপ্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ফ্রান্সের দিক থেকেও নেই কোনো সুখবর। সেখানেও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের স্থানীয়রা অনেকটাই শত্রু হিসেবেই দেখেন।
ফ্রান্সের সরকারও অভিবাসবিরোধী অবস্থানই নিয়েছে। এ কারণে ক্যালাই জঙ্গলের সেই শরণার্থী শিবির উচ্ছেদের পর এখনও পুলিশ ছোট ছোট শিবিরগুলোতেও নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সাহায্যকারী ভ্যানগুলোর পার্কিং ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ নিয়মিত বিতরণ পয়েন্টগুলোর কয়েকটিতে বড় বড় পাথর ও বোল্ডার স্থাপন করেছে। ব্রেক্সিটের কারণে পোশাক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আসাও কমে গেছে।
যুক্তরাজ্যের এই শরণার্থীবিরোধী বিল আনার পক্ষে ও বিপক্ষে রয়েছে জনমত ও চাপ। মানবতাবাদী সংস্থাগুলোর মতে, এর মাধ্যমে কেবল মানুষের জীবনই হুমকির মুখে পড়ছে, আর কিছু নয়। কারণ যারা মরিয়া হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের হাতে আর কোনো উপায় নেই।
ক্যালাইয়ের শরণার্থীদের প্রাত্যহিক রুটিন একই। প্রতিদিন মধ্যরাতে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা চালাতে হয়। তাই দিনের বেলাতেই কিছুটা ঘুমিয়ে নেওয়া। টাকা না থাকায় পাচারকারীদের সাহায্যে সাগর পাড়ি দেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই নিজেদেরই নৌকা জোগাড় করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ দিনেই তারা সাগর পাড়ি দিতে পারে না। তাই ভোর ৬টা বাজতেই শিবিরের ডেরায় ফিরে সামান্য যা জিনিসপত্র, সেগুলো নিরাপদ জায়গায় সরাতে হয়। কারণ প্রতিদিন সকালে পুলিশ আসে উচ্ছেদ করতে। সারাদিন এভাবে দৌড়াদৌড়িতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। ফলে রাত ৮টা বাজেই শুয়ে পড়তে হয়। আবার রাত ১২টা থেকে শুরু হয় সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা।
এই রুটিন তাদের নিত্যদিনের। ফলাফল চোখের নিচে কালি, শীর্ণ শরীর। স্বাস্থ্যের অবস্থা এতটাই নাজুক যে কোমর থেকে প্যান্ট যেন পড়ে যাবে। গায়ের এখানে-সেখানে পুলিশের লাঠির বাড়ির চিহ্ন বা ব্যথা। শরণার্থীদের খাবার ও পোশাক দেওয়া হলেও পানির সংযোগ, বিদ্যুৎ ও মাথার ওপর ছাদ বানানোর অনুমতি নেই। এ যেন আরেক যুদ্ধক্ষেত্র।
নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কিছু সাহায্যকারী সংস্থা এখনো পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এসব শরণার্থীদের। কোনোমতে বেঁচে থাকা এই মানুষগুলোর জন্য খাবার, পানি, কাপড়, জ্বালানি কাঠ, কম্বল ইত্যাদির মতো বেঁচে থাকার মৌলিক কিছু উপকরণ সরবরাহ করছে তারা। মোবাইল চার্জ দেওয়ার মতো সুবিধাও তারা ভাগ্যবিড়ম্বিত এসব মানুষকে দিয়ে যাচ্ছে। নানা বাধা সত্ত্বেও তাদের জন্য কাজ করছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও। ‘চুজ লাভ’ এমনই একটি সংগঠন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক বড় তারকা। এই সংস্থার মাধ্যমে কোল্ডপ্লে, দুয়া লিপা, অলিভিয়া কোলম্যান, জুড ল, স্টেলা ম্যাককার্টনি ও অন্যান্য তারকা বড় অঙ্কের অনুদান দিয়ে থাকে উত্তর ফ্রান্সের এই শরণার্থীদের জন্য।
ক্যালাইয়ের অধিকাংশ শরণার্থী সুদান, ইরিত্রিয়া ও কুর্দিস্তানের। সম্প্রতি ভিয়েতনামের কিছু অধিবাসীও যুক্ত হয়েছেন এই তালিকায়। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ রয়েছেন এই তালিকায়। এর বড় একটি অংশ নারীও। কমবেশি সবারই নিজ দেশে নির্যাতনের শিকার হওয়ার দুর্বিষহ ইতিহাস আছে। শুধু সাগর পাড়ি দিয়েই নয়, সাহায্যকারী সংস্থার ট্রাকের চাকায় লুকিয়ে যাওয়ার সময় প্রাণ হারানোর ঘটনাও আছে।
এসব অধিবাসীরা যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির আশ্রয়প্রার্থী। ২০২০ সালে কেবল ব্রিটেনেই ২৯ হাজার ৪৫৬ জন শরণার্থী রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছে। অন্যদিকে ফ্রান্সের কাছে এমন আবেদন জমা পড়েছে ৯৩ হাজার ৪৭৫টি, জার্মানিতে ১ লাখ ২১ হাজার ৯৫৫টি। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। একইসঙ্গে উত্তর ফ্রান্স থেকে যুক্তরাজ্য অভিমুখে শরণার্থীবাহী ছোট ছোট নৌকার সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
আশ্রয়প্রার্থী ইংলিশ চ্যানেল ক্যালাই ক্যালাইয়ের শরণার্থী চুজ লাভ যুক্তরাজ্যের শরণার্থীবিরোধী বিল রাজনৈতিক আশ্রয় শরনার্থী শরনার্থী সংকট