মানুষের সচেতনতার কারণে রাজস্ব আদায় বেড়েছে
৫ নভেম্বর ২০২১ ২০:৩৯
দেশে রাজস্ব আদায় বেড়ে যাওয়ার কারণেই সরকারের কোষাগার স্ফীত হয়েছে, যা দিয়ে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণসহ সরকার সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারছে। একইসঙ্গে কমেছে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা। ভ্যাট ও ট্যাক্স দেওয়ার বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে বলেই এটি সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (পরিসংখ্যান ও গবেষণা) মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হোসাইন।
সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারস পাওয়ার্ড বাই প্রিমিয়ার ব্যাংক’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। গত বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানের পর্বটিতে আলোচনার বিষয় ছিল ‘ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রদানে মানুষ কতটুকু সচেতন’।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার ইফ্ফাত গিয়াস আরেফিনের পরিকল্পনা ও সঞ্চালনায় এবারের পর্বে এনবিআর মহাপরিচালকের সঙ্গে সম্মানিত আলোচক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহ্ মনজুরুল হক।
আরও পড়ুন- আয়কর রিটার্নের জন্য ফরম পূরণ করবেন যেভাবে
আলোচনায় এনবিআর মহাপরিচালক বলেন, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) পরোক্ষ কর ব্যবস্থা। আইন অনুযায়ী ভোক্তা এই কর দেবেন। যেকোনো ধরনের পণ্য বা সেবার ওপর নির্দিষ্ট হারে এই ভ্যাট দেওয়া হয়। আধুনিক এই ব্যবস্থা প্রতিবেশী দেশগুলোতে অনেক আগে চালু হলেও বাংলাদেশে প্রথম চালু হয় ১৯৯১ সালে। এই ব্যবস্থায় ভ্যাট সংগ্রহীতা (ব্যবসায়ী, বিক্রেতা) ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করে সরকারের কাছে জমা দেয়।
তিনি বলেন, এরপর থেকে গত ৩০ বছরে মানুষ এই ভ্যাট দিতে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কর আদায়ের সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ক্রেতা-বিক্রেতা (যিনি সরকারের হয়ে ভ্যাট আদায় করেন)— সব পক্ষই এ বিষয়ে বেশ সচেতন হয়েছেন। ফলে সত্তরের দশকে দেশে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো, এখন তার চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি রাজস্ব আদায় হচ্ছে। বর্তমানে এর পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি।
আনোয়ার হোসাইন বলেন, প্রতিবছর কর আদায়ের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি ঘটছে বাংলাদেশে। মানুষের কর সচেতনতা বেড়েছে বলেই এই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। ফলে উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হচ্ছে নিজস্ব আয় থেকেই। জনগণের আগ্রহ ও সচেতনতার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। দিন দিন কর দেওয়ার প্রতি মানুষের এই সচেতনতা বাড়ছে।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ— দুই ধরনের কর ব্যবস্থায় মানুষকে কর দিতে বেশি খরচ করতে হচ্ছে— এমন ধারণা রয়েছে অনেকেরই। এ বিষয়ে এনবিআর মহাপরিচালক আনোয়ার হোসাইন বলেন, অনেকেই ভাবেন দুই ধরনের কর ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে তুলনামূলকভাবে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু এই দুই ধরনের করের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর হলো আয়কর। অন্যদিকে পরোক্ষ কর হলো মূসক বা ভ্যাট, যা মূলত ব্যয়কর। একটির মাধ্যমে মানুষ তার আয়ের ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে কর দেয়, অন্যটিতে তাদের কর দিতে হয় কেনাকাটার ওপর। এটি ক্রেতার ওপর বাড়তি কোনো চাপ নয়।
তিনি বলেন, কোনো বিক্রেতা যদি ট্যাক্স বাবদ ক্রেতার কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম নেয় বা সরকারকে সেই কর না দেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। অনেক সময় ট্যাক্স ফাঁকি দিতে কোনো কোনো বিক্রেতা পণ্য বা সেবা বিক্রির সময় ক্রেতাকে বলে থাকেন, ভ্যাট না দিলে দাম কম হবে। এরকম প্রলোভন বেআইনি। এখানে ক্রেতাকেও সচেতন হতে হবে, যেন তাদের দেওয়া ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়।
অ্যাডভোকেট শাহ্ মঞ্জুরুল হক বলেন, রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমেই দেশের উন্নয়ন ব্যয়সহ অন্যান্য পরিচালন ব্যয় নির্বাহ হয়। এটি ছাড়াও অন্যান্য উপায়েও একটি সরকারকে টাকা উপার্জন করতে হয়। তবে সবচেয়ে বড় আয়ের মাধ্যম রাজস্ব আদায়। এটি দুইভাবে আদায় হয়— ভ্যাট বা আয়কর এবং ব্যয়ের ওপর কর বা মূসক। মূসক বা মূল্য সংযোজন কর পণ্য ও ব্যবসাভেদে ৪ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। ১৯৯১ সালে জাতীয় রাজস্ব আইন ও ২০১২ সালে আনা সংশোধনীর পর একজন বিক্রেতা ক্রেতার কাছ থেকে এই ভ্যাট আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেন।
তিনি বলেন, সাধারণ কাঁচাবাজার বা মুদি দোকানে এই পদ্ধতি না থাকলেও শপিং মল, গ্রোসারি স্টোর বা অন্যান্য দোকানে ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা হয়। সেই টাকা সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া তার দায়িত্ব। না দিলে তিনি আইনের চোখে অপরাধী বলে বিবেচিত হবেন। এখানে তিনি ভ্যাট আদায়কারী, এর ভোগকারী নন। এই টাকা দিয়েই সরকারি ব্যয় নির্বাহ হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভ্যাটগ্রহীতারা সরকারি কোষাগারে ভ্যাটের টাকা ঠিকভাবে জমা দেন না। এর জন্য তারা দুইটি ব্যাংক হিসাব রাখেন। একটি হিসাবে ভ্যাটের টাকা গ্রহণ করেন, অন্যটিতে অন্য আয়ের টাকা। এভাবে সরাকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করেন অনেকেই।
তিনি বলেন, ভ্যাট প্রতিদিন দেওয়া হলেও ট্যাক্স প্রতিদিনের বিষয় নয়। বছরে একবারই আয়কর দিতে হয়। ব্যক্তিগত আয় ও করপোরেট আয়ের জন্য এটি আলাদা আলাদা হারে নির্ধারিত হয়।
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, সমালোচনা আছে— আমাদের দেশে সক্ষম মানুষের সংখ্যা অনুযায়ী ভ্যাটের নিবন্ধনকারী কম। সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্যাক্স দেওয়া নিয়ে নানা ভীতি আছে। তারা মনে করেন, ভ্যাট একবার দিলেই বোধহয় বছর বছর ট্যাক্স কর্মকর্তারা হয়রানি করবেন। অনেকসময় আইনজীবীরাও মানুষকে ভুল বোঝান বা ভয় দেখান। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়োজিত আয়কর মেলার আয়োজনকে তিনি সাধুবাদ জানান।
শাহ্ মনজুরুল হক বলেন, এই মেলার মাধ্যমে মানুষের আয়কর দেওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাচ্ছে। তারা আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তবে জনসচেতনতা বাড়াতে এই কার্যক্রম আরও ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। শুধু সরকারিভাবে সচেতনতা তৈরিই নয়, জনগণের নিজেরও সচেতন হওয়া উচিত বলে মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
ভ্যাট কী
ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের সংক্ষিপ্ত রূপ ভ্যাট। এর বাংলা মূল্য সংযোজন কর বা মূসক। এটি রাজস্ব আদায়ের পরোক্ষ পদ্ধতি। যেকোনো মূল্যের পণ্য বা সেবা কিনলে সেই মূল্যের ওপর যে কর দেওয়া হয়, সেটিই ভ্যাট বা মূসক। এই পদ্ধতিতে ক্রেতা সরাসরি নন, বিক্রেতার মাধ্যমে সরকারকে কর দেন। বিক্রেতার দায়িত্ব সরকারের কাছে করের এই টাকা পৌঁছে দেওয়া। না দিলে তিনি অপরাধ করছেন। যেকোনো দামের পণ্য বা সেবা কিনলেই যেহেতু ভ্যাট দিতে হয়, তাই বয়স বা আয় নির্বিশেষে সবাই এই কর দিয়ে থাকেন।
ট্যাক্স কী
সবাইকে পণ্য বা সেবা কিনলেই ভ্যাট দিতে হলেও ট্যাক্স সবার জন্য বাধ্যতামূলক না। একজন নাগরিক বছরে একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক বা তার চেয়ে বেশি আয় করলে তার জন্য নির্ধারিত যে হারে সরকারি কোষাগারে কর জমা দিতে হয়, সেটিই ট্যাক্স। আয়ের ওপর দিতে হয় বলেই একে আয়কর বলা হয়। নারী ও পুরুষের জন্য আয়করের হিসাব আলাদা। পুরুষের ক্ষেত্রে বাৎসরিক তিন লাখ টাকা বা তার বেশি এবং নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী কারও ক্ষেত্রে বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকা বা তার বেশি আয় হলে তবেই তিনি আয়কর দেবেন। তিন লাখের পরের আয়ের ১ লাখ টাকার ওপর পাঁচ শতাংশ কর দিতে হয়। অর্থাৎ কারও বার্ষিক আয় যদি চার লাখ টাকা হয়, তবে তাকে বছরে পাঁচ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হবে।
তিন লাখ পর পরবর্তী তিন লাখ টাকার ট্যাক্স হবে ১০ শতাংশ, চার লাখে ১৫ শতাংশ এবং পাঁচ লাখের বেশি হলে ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। আর কারও আয় তিন লাখের পর পাঁচ লাখের বেশি হলে ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এভাবে যত বেশি আয়, করের পরিমাণও তত বেশি।
গত কয়েক বছর ধরেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নভেম্বর মাসের শুরুতে করমেলা আয়োজন করে থাকে। এই মেলায় আয়কর রিটার্ন দাখিলসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা মেলে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় গত বছর এই মেলা হয়নি, হচ্ছে না এ বছরও। তবে নভেম্বর মাসজুড়েই কর কার্যালয়গুলোতে আয়কর রিটার্ন দাখিল সংক্রান্ত বিশেষ সেবা থাকছে।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর