Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন গড়ার ডাক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৬ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৫১

চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে গণসমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। যাতে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজন ও সংস্কৃতিকর্মীরা। গণসমাবেশে বক্তারা বলেছেন, ভোটের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ধারাবাহিকভাবে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপস করে চলছে। যেসব রাজনৈতিক দল ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের সময় তারা নীরব ভূমিকা পালন করে। কারণ, সংখ্যালঘুরা চলে গেলে তাদের সম্পত্তি দখল করা যায়। ভোট এবং সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্য থেকেই সমাজে সাম্প্রদায়িকতা-উগ্রবাদের বিস্তার ঘটেছে। আর এ কারণেই সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন গড়ার ডাক দিয়েছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (৬ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর ডিসি হিলের মুক্তাঙ্গনে ‘সর্বস্তরের সাংস্কৃতিক কর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজ’ এই গণসমাবেশের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। গণসমাবেশে শেষে ডিসি হিল থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যান বিশিষ্টজন ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা।

সমাবেশে শহিদজায়া বেগম মুশতারি শফী বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের চেহারা দেখে নিজের বড় খারাপ লাগে। আমরা শিশুকাল থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বড় হয়েছি। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখেছিলাম। আমরা মুসলমান, আমরা নামাজ পড়ি, আমরা রোজা রাখি। আমরা যে যার যার ধর্ম পালন করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি। আমার বাসার সামনে একটি মন্দির। ডানপাশে আরেকটি মন্দির। তারা পূজা করছে, আমরা নামাজ পড়ছি- আমাদের কিংবা তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ছেলেবেলা থেকেই এই শিক্ষাটা পেয়েছি। এই শিক্ষা নিয়েই ধর্ম পালন করছি। আমরা মানুষকে ভালোবেসেছি।’

‘আমরা অনেক কষ্ট করে এই বাংলাদেশ অর্জন করেছি। আমরা যুদ্ধ করে পাকিস্তানের কাছ থেকে এই বাংলাদেশ ছিনিয়ে এনেছি। ১৯৫২ সাল থেকে ধারাবাহিক সংগ্রাম, লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা শান্তির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- কাউকে যেন আলাদা করে দেখা না হয়, আমরা সবাই মানুষ। এই বাংলাদেশকে শান্তির বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই।’

কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘আমরা ১৯৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই সংগ্রাম করেছি। ছয় দফা থেকে যে উত্তরণ ঘটেছে এ জাতির, সেটাও ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরা। আদিবাসিরাও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ফলে এই ভূখণ্ডের সকল মানুষের দেশ এটি। এই দেশে রাষ্ট্রধর্ম কেন থাকবে? রাষ্ট্র গঠিত হয় তিনটা অঙ্গ নিয়ে- প্রশাসন, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ। প্রশাসনের পরিচালনায় থাকে সরকার। সেটি গণতন্ত্রে জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার কথা। কাজেই এই অঙ্গগুলোর তো ধর্ম পালনের কোনো সুযোগ নেই। এগুলোকে প্রত্যেক ধর্মের মানুষকে সেবা দিতে হবে। প্রত্যেক ধর্মের মানুষই তাদের কাছ থেকে কোনো না কোনো সেবা লাভ করে থাকে। এখানে বিভেদ সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না।’

বিজ্ঞাপন

সংবিধানের সংশোধনের দাবি জোরালোভাবে তোলার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেওয়ার জন্য আমাদের সামাজিক জায়গা থেকে চাপ তৈরি করতে হবে। এটাই আমাদের আজকের আয়োজনের মূল বিষয়। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সব ধর্মের মানুষ মিলে বাঙালি জাতীয়তার জাগরণ, বাঙালি ঐতিহ্যের লালন- আমাদের চেতনার পুনর্জাগরণে সকলকে আরও অনেক কাজ করতে হবে।’

বিক্ষোভ মিছিল শেষে সমবেতদের উদ্দেশে আবুল মোমেন বলেন, ‘সমাবেশে একটা কথা উঠেছে যে, ভোট এবং সম্পত্তির জন্যই সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটানো হয়েছে। ফলে বিভেদ আমাদের সমাজে বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে। এ অবস্থায় সমাজের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। সমাজের পুনর্গঠন, পুনরুজ্জীবন- এজন্য আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’

সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এটাকে বারবার বিপথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে সরকারি দলসহ বিভিন্ন দল জড়িত। উদ্দেশ্য হচ্ছে- রাজনীতি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল ও লুটপাট। প্রশাসনে কারা বসে আছেন, তাদের মতলবটা কি আমরা বুঝি না। প্রশাসন যদি সক্রিয় থাকত, একটি সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটতে পারত না।’

বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘স্বৈরশাসক এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে এদেশের বাকি নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসার এবং থাকার পথ তৈরি হয়েছে। সমাজে ধর্মীয় উগ্রবাদ বেড়েছে। এটা যে শুধু মুসলমানদের মধ্যে তা নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। এই সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করেছে। তথাকথিত কওমি মাতা উপাধি নেওয়ার জন্য মাদরাসার ছাত্রদের কোনো যাচাইবাছাই ছাড়া মাস্টার্সের সনদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে বাঙালি প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবকিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে- ক্ষমতা, ভোট এবং লুটপাট।’

তিনি বলেন, ‘আজ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে ধর্মহীনতার কথা নিয়ে আসা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে জাতির মধ্যে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তোলা হয়েছিল, আজ আবারও সেই জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। দেশকে সেই অসাম্প্রদায়িক জাগরণের জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।’

খেলাঘরের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলের নেতাদের হাতে যেদিন থেকে তসবিহ উঠেছে, মাথায় টুপি উঠেছে, ওমরাহ করতে যাওয়া বেড়ে গেছে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার শুরু হয়েছে। এই দল আজ ১২-১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে, অথচ সাম্প্রদায়িকতা রুখতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতাদের বলছি- ভোটের জন্য যাদের সঙ্গে আপস করেন তারা কোনোদিন আপনাদের ভোট দেবে না। আপনাদের দল এমন মানুষের ভরে গেছে যারা মনে করেন- হিন্দুরা থাকলে ভোট পাব, চলে গেলে জমি পাব। দলটাকে শুদ্ধ করুন। বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনুন। জামায়াত আওয়ামী লীগের ৩০ শতাংশ এমপি পদ দখল করার ঘোষণা দিয়েছে। আমার মনে হয়, ৩০ শতাংশ না পারলেও ইতোমধ্যে তারা অনেকদূর এগিয়েছে।’

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক রণজিৎ কুমার দে বলেন, ‘অনেকেই বলেন, ‘আপনারা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কেন করেছেন, এখানে মুসলিম কোথায়। আমরা বলি যে, আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীতে মুসলিম আছেন, ‍আমাদের সভা-সমাবেশে মুসলিমরা অবশ্যই থাকেন। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ করেছি, সেজন্য আমাদেরও দুঃখবোধ আছে, কিন্তু সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম না আনলে আমাদের ঐক্য পরিষদ করতে হত না। আমরা ঐক্য পরিষদ করতে বাধ্য হয়েছি।’

শিক্ষাবিদ আনোয়ারা আলম বলেন, ‘সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু এসব শব্দ আমরা আর শুনতে চাই না। আমরা সবাই বাঙালি। আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই, মহামিলনের বাংলাদেশ চাই। যারা সাম্প্রদায়িক হামলা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশের শুরুতে উদীচী ও রক্তকরবী সংগঠনের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এছাড়া সমাবেশে আবৃত্তিও পরিবেশিত হয়।

সাম্প্রদায়িক হামলার শ্বেতপত্র দাবি ওয়ার্কার্স পার্টির

এদিকে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলার শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা ওয়ার্কার্স পার্টি। শনিবার বিকেলে নগরীর চেরাগি চত্বরে আয়োজিত মানববন্ধন ও সমাবেশ থেকে এ দাবি জানানো হয়েছে।

সমাবেশে ওয়ার্কার্স পার্টির চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান বলেন, ‘এ যাবৎ সাম্প্রদায়িক হামলার যত ঘটনা ঘটেছে তার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে প্রকৃত দোষীদের বিচার করতে হবে। সংবিধান যে অধিকার দিয়েছে তা নিশ্চিত করে সব ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশকে সম্প্রীতির বাংলাদেশ করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যেন জীবন নির্বাহ করতে পারে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। দ্রব্যমূল্য কমিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফেরাতে হবে।’

চট্টগ্রাম জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মনসুর মাসুদের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- জেলা কমিটির সদস্য দিদারুল আলম চৌধুরী, শ্রমিক নেতা আবদুল খালেক জেলা যুব মৈত্রীর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক খোকন মিয়া এবং জেলা ছাত্র মৈত্রীর আহবায়ক মো. আলাউদ্দিন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

রাষ্ট্রধর্ম সংবিধান

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর