‘গরু-ছাগলের চেয়েও মানবেতর জীবন, তাও নিশ্চিহ্নের পাঁয়তারা চলছে’
৭ নভেম্বর ২০২১ ২২:৪১
ঢাকা: স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিরা বিহারি ক্যাম্পে বসবাস করে আসছেন গত পাঁচ দশক ধরে। এই সময়ে মানবেতর জীবনযাপনসহ বিভিন্ন ধরনের অসুবিধার অভিযোগ তারা করে আসছেন দীর্ঘ দিন ধরেই। বিহারিদের সংগঠন ‘ওয়েলফেয়ার মিশন অব বিহারিজ বাংলাদেশ’ অভিযোগ করছে, কোনোমতে বেঁচে থাকাটাই তাদের জীবন হলেও তাদের আশ্রয়স্থলটুকুও কেড়ে নেওয়ার ‘ষড়যন্ত্র’ করা হচ্ছে।
রোববার (৭ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ডিআরইউ সাগর রুনী মিলনায়তনে বিহারিদের সংগঠন ‘ওয়েলফেয়ার মিশন অব বিহারিজ বাংলাদেশ’ এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিহারিরা বসবাস করছেন। কিন্তু এসব এলাকার বিহারি ক্যাম্পগুলো দখলের চেষ্টা চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ বলেন, আমরা জীবনযাপনে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জীবিকার জন্য ও মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্যে লড়াই করে যাচ্ছি। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে অমান্য করে বেপরোয়াভাবে আমাদের ক্যাম্প ও দোকানপাট বুলডোজার দিয়ে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আমাদের আশ্রয় ও জীবিকার শেষ ঠিকানাও তারা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
মোস্তাক আহমেদ অভিযোগ জানিয়ে বলেন, গত ২১, ২২ ও ২৩ জানুয়ারী মিরপুর ১১ নম্বরের ৪ নম্বর রোডে সড়ক উন্নয়নের নামে বিহারিদের কয়েকশ ঘর ভেঙে ফেলা হয়। এ কারণে শতাধিক বিহারি পরিবারকে এখন খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের আশ্বাস দিলেও করপোরেশনের কর্মকর্তারা আবারও বিহারি ক্যাম্প উচ্ছেদের হুমকি দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
মোস্তাক আহমেদ বলেন, ৫০ বছর ধরে পাঁচ লাখ বাংলাদেশি উর্দুভাষী বিহারী দেশের ১৩টি জেলায় বসবাস করে আসছে। ঢাকায় মিপুর ১০, ১১ ও ১২ নম্বর এবং মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে তারা বসবাস করেন। এসব বিহারি ক্যাম্পে তারা গরু-ছাগলের চেয়েও কষ্টের জীবনযাপন করছেন। তারপরও রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষার হাত না পেতে এই অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত উর্দুভাষী বিহারী জনগোষ্ঠী দেশের ওপর বোঝা না হয়ে কঠিন মেহনত, মজদুরি ও মেধা দিয়ে জীবিকা অর্জন করে আসছে। এরপরও কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল ক্যাম্পের উর্দুভাষী বিহারীদের নাগরিকত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে।
তিনি বলেন, উর্দুভাষী বিহারিদের পাকিস্তানি, কখনো আটকে পড়া পাকিস্তানি বলে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর যেভাবে বাঙালিরা বাংলাদেশি নাগরিক হয়েছে, একইভাবে উর্দুভাষীরাও বাংলাদেশি নাগরিক হয়েছে। আজ পর্যন্ত কোনো আইন বা কোনো আদেশের মাধ্যমে তাদের কারও নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়নি। বরং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন এক রায়ে বিহারি জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনকে বিহারি ক্যাম্পের অধিবাসী উর্দুভাষীদের ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিহারিদের এই নেতা বলেন, মিরপুর ১১ নম্বরে একটি নন-লোকাল বাজার বসত। পরে নন-লোকাল শব্দগুলো বাদ দিয়ে ‘নিউ সোসাইটি’ নাম দিয়ে ৬ বিঘা জমি বরাদ্দ করে সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সিটি করপোরেশন ওই জায়গায় দোকান নির্মাণ করে নিউ সোসাইটি মালিকদের নামে বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলেন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১৬ কোটি টাকা তুলে নেয়। কিন্তু মার্কেটের দোকানদারদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ হয়ে তারা ব্যবসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন। সিটি করপোরেশনও কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।
বিহারিদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে ৬ দফা দাবি তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। দাবিগুলো হলো— পুনর্বাসনের আগে ক্যাম্প উচ্ছেদের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে; স্থায়ী পুনর্বাসন ছাড়া স্থানান্তরের পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে; মৌলিক অধিকার পূরণের নিশ্চয়তা দিতে হবে; এরই মধ্যে মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে উচ্ছেদ করা পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে; উর্দুভাষীদের নিয়ে ৫০ বছর ধরে চলে আসা সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট অধিদফতর, বিশেষ করে ডিএনসিসি মেয়র, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের উর্দুভাষী বিহারি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে; এবং অবিলম্বে নিউ সোসাইটি মার্কেটের দোকানদারদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিহারিদের সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মোস্তাক আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করছি— পাঁচ লাখ অসহায় মানুষের সমস্যা সমাধান আপনি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। ৫ লাখ নিপীড়িত মানুষ আপনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আপনি তাদের নিরাশ করবেন না— এটি তাদের বিশ্বাস।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর
ওয়েলফেয়ার মিশন অব বিহারিজ বাংলাদেশ বিহারি ক্যাম্প বিহারি ক্যাম্প উচ্ছেদ