ওয়েবিলের নামে ‘ভাঁওতাবাজি’, ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য
৯ নভেম্বর ২০২১ ২৩:২০
ঢাকা: রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনের যারা চলাচল করেন, তাদের কাছে খুবই পরিচিত একটা শব্দ ‘ওয়েবিল’। বাসের সুপারভাইজাররা অবশ্য এটিকে বলে থাকে ‘ওবিল’। যাত্রীদের অভিযোগ, এই ওয়েবিলের কলমের খোঁচায় দিনে-দুপুরে যাত্রীদের পকেট কেটে নিচ্ছে পরিবহন মালিকরা। সম্প্রতি জ্বালানি তেল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। এরপর গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে অঘোষিত ধর্মঘট চলে কয়েকদিন। এক পর্যায়ে সরকার পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বসে বাস ভাড়া সমন্বয় করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাসভাড়া প্রায় ২৭ শতাংশ বাড়ানোর হয়েছে। সরকার কিলোমিটারপ্রতি বাসের ভাড়া বৃদ্ধি করলেও ওয়েবিল নৈরাজ্যের কারণে যাত্রীদের গুণতে হচ্ছে মূল ভাড়ার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি টাকা।
মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) সকাল ৯টা। রজনীগন্ধা পরিবহনের একটি বাসে রাজধানীর ধানমন্ডি-১৫ থেকে মৎস্য ভবন এসে নেমেছেন সোহেল নামে এক যাত্রী। তার কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হয়েছে ২৫ টাকা। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী, এই পথের দূরত্ব চার দশমিক তিন কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ১৫ পয়সা ধরে সর্বমোট ভাড়া আসার কথা ৯ টাকা ২৪ পয়সা। সেক্ষেত্রে তারা সর্বনিম্ন ১০টাকা ভাড়া আদায় করতে পারে। কিন্তু যাত্রীর কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে মূল ভাড়ার আড়াই গুণ বেশি!
সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিবহন মালিকদের করা এই ওয়েবিলের কারণে নির্ধারিত ভাড়ার প্রায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি টাকা গুনতে হয় যাত্রীদের। বছরের পর বছর এই ওয়েবিল নৈরাজ্য চলে এলেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার। ওয়েবিল যেন যাত্রীদের গলার কাটা। অবিলম্বে এটি বন্ধ হওয়া দরকার। আমরা প্রতিবাদ করেও তেমন লাভ হয় না।’
মিরপুর-১২ থেকে সদরঘাটগামী বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে আতাউর রহমান রুবেল আগারগাঁও থেকে পল্টনে আসেন। ওয়েবিলের কারণে তিনি ৩০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা দিয়ে এসেছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যেখানে সর্বোচ্চ ভাড়া হতে পারে ২০ টাকা, সেখানে ৪০ টাকা দিতে হয়েছে। শুধু পল্টন নয়, কেউ যদি আগারগাঁওয়ে উঠে শাহবাগেও নামেন তাকেও ৪০ টাকা দিতে হয়। যা রীতিমতো যাত্রীদের ওপর জুলুম।’
রুবেল বলেন, ‘ওয়েবিল বন্ধ করতে হবে। এটা অবৈধ। ওয়েবিল দেখিয়ে ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে। যাত্রীরা এটাকে বৈধ মনে করে কেউ কিছু বলছে না। সবাইকে একযোগে প্রতিবাদ করতে হবে। এদিকে মালিকরা বাসে নতুন কোনো ভাড়ার তালিকাও লাগায়নি। জানতে চাইলে সুপারভাইজার জানায়, কয়েকদিনের মধ্যে মধ্যে ভাড়ার তালিকা লাগানো হবে। এই ফাঁকে তারা বেশি ভাড়া নিয়ে নিচ্ছে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ’র পরিচালক এবং মুখপাত্র শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিআরটিএ’র সিস্টেমে ওয়েবিল বলে কিছু নেই। নির্দিষ্ট ভাড়ার চার্ট গাড়িতে দেওয়া আছে। সেই অনুযায়ী যাত্রীরা ভাড়া পরিশোধ করবেন।’
মিরপুর-১ থেকে বনানী, মহাখালী হয়ে মতিঝিল রুটে চলাচল করে মক্কা পরিবহন। রুটের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটারের মতো। বাড়তি ভাড়াসহ হিসাব করলে সর্বোচ্চ ভাড়া আসার কথা ৩৮ টাকা। কিন্তু বাসটিতে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ৫০ টাকা। বাড়তি ভাড়ার আগে আদায় করা হতো ৪০ টাকা। এর মধ্যেও আছে ওয়েবিল নৈরাজ্য।
এই রুটের নিয়মিত যাত্রী ফারুক জানান, তাকে ইসিবি চত্বর থেকে প্রায়ই সাত রাস্তা পর্যন্ত আসতে হয়। সেক্ষেত্রে তিব্বতে একটা ওয়েবিল চেক থাকায় তার কাছ থেকে আগে আদায় করা হতো ৪০ টাকা। বর্তমানে আদায় করা হচ্ছে ৫০ টাকা। অথচ দূরত্ব ও বিআরটিএর নতুন ভাড়ার চার্ট অনুযায়ী তার ভাড়া আসার কথা ২৩ টাকার মতো। তার কাছ থেকে নিয়মিত দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
প্রতিদিন মেরাদিয়া থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত তরঙ্গ প্লাস বাসে আসেন সাইদুর রহমান। এই পথের দূরত্ব ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার। সরকারি হিসাবে এই দূরত্বে সর্বনিম্ন ৮ টাকা ভাড়া আদায়ের কথা রয়েছে। কিন্তু তাকে গুনতে হচ্ছে ১৫ টাকা। এর মূলেও সেই ওয়েবিল নৈরাজ্য। বাসে ওঠা মাত্র ১৫ টাকা বিল লিখে দেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর সব রুটেই ওয়েবিল নৈরাজ্যের শিকার গণপরিবহনের যাত্রীরা। এক সময় এসব বাসে কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া আদায় করতেন সুপারভাইজাররা। পরে কাউন্টারে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এরপর আসে সিটিং সিস্টেম। সেখানে সিটিং সার্ভিসের কথা বলে যাত্রীদের পকেট কাটা হতো। সর্বশেষ পরিবহন মালিকরা ওয়েবিল বাণিজ্য চালিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে বিআরটিএ’র মুখপাত্র শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ‘বাসে ওয়েবিলকে পুঁজি করে ভাড়া আদায় অবৈধ। এমন কিছু থাকলে আমরা পরবর্তী কোনো অপারেশনে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’
সারাবাংলা/এএম/ইউজে/পিটিএম