গর্ভবতী নারী ও ভ্রূণ জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি শিকার
৯ নভেম্বর ২০২১ ২৩:৪২
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে আছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের মধ্যে গর্ভবতী নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেলের আলোচনায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নারীরা বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বেশি নির্ভরশীল। সে কারণেই তাদের ওপর তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের আলোচনার বিষয় ছিল ‘জেন্ডার’। এ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সিবিসি নিউজে গর্ভবতী নারীদের ওপর তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব সংক্রান্ত এই খবর প্রকাশিত হয়।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জনস্বাস্থ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মোটরগাড়ির ধোঁয়া, জীবাশ্ব জ্বালানি, কাঠ পোড়ানো ও দাবানলের ধোঁয়া বায়ুর গুণমান হ্রাস করছে। এর ফলে ঝুঁকিতে আছে এমন জনসংখ্যা যেমন— গর্ভবতী নারী ও গর্ভস্থ ভ্রূণ সবচেয়ে বেশি হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও মানসিক চাপের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ু দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু বিষয়ক তীব্রতা অনেকটাই বেড়েছে। আর এই তীব্রতা প্রসূতি, ভ্রূণ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৩ কোটি ২০ লাখ প্রসবের ঘটনা পর্যালোচনা করে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বা জামা নেওয়ার্ক। তাদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বায়ুদূষণ ও উষ্ণায়ন প্রসূতি, ভ্রূণ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া পরিবেশ সুরক্ষা বিভাগের বায়ু ও জলবায়ু মহামারি বিভাগের প্রধান ও জামা স্টাডির অন্যতম গবেষক রুপা বসু বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো গর্ভাবস্থায় বায়ু ও তাপমাত্রার ধারাবাহিক প্রভাব লক্ষ করেছেন গবেষকরা। এই প্রভাব গর্ভধারণ পর্যায় থেকে শুরু করে মৃত শিশু জন্ম দেওয়া, জন্মহার কমে যাওয়া, কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়া নির্ধারিত সময়ের পূর্বে শিশুর জন্মসহ নানা সমস্যার সঙ্গে জড়িত।
রুপা বসু জানাচ্ছেন, বায়ু দূষণের সঙ্গে জড়িত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কণা মায়ের ফুসফুসে পৌঁছাতে সক্ষম, যা তাদের ফুসফুসের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। এসব কণা প্লাসেন্টায় পৌঁছে প্রদাহ তৈরি করে, যা গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস ও প্রি-অ্যাকলেমসিয়ার জন্য দায়ী। অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া গর্ভবতী নারীর মানসিক চাপ বাড়িয়ে ঝিঁমুনি থেকে শুরু করে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের জন্যও দায়ী হতে পারে।
এই পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অ্যাজমা আছে— এমন নারীদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু বিশেষ করে কালো নারীদের গর্ভাবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বার্থ ইকুইটি কোলাবোরেটিভের বার্থ ইকুইটি ইনোভেশনের প্রধান কেলি ডেভিস বলেন, গর্ভাবস্থায় প্রাকৃতিকভাবে মানসিক চাপের পরীক্ষা হয়। তাই মানুষ যদি আগে থেকেই পরিবেশগত বর্ণবাদ, অবিচারের চাপে থাকে তা গর্ভাবস্থা ও প্রসবের নাজুক সময়ের চাপকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
পরিবেশ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরাম, যেমন— জাতিসংঘের সামিটের মতো জায়গাতেও প্রান্তিক গোষ্ঠীকে নিয়ে আলোচনা উহ্য থেকে যায় বলে সিবিসি নিউজের কাছে অভিযোগ করেন ডেভিস। তিনি বলেন, অনেকসময় জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষ্যমাত্রা এতটাই উচ্চাশার যে সেখান গর্ভবতী ও কালো নারীরা যে জরুরি ও পরিবেশগত উদ্বেগের মুখোমুখি হয় তা কোনো গুরুত্বই পায় না। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) ও প্রিভেনশনের তথ্য বলছে, সেখানে সাদাদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসী নারীর গর্ভাবস্থায় মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নারী অধিকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ গবেষক স্কাই হুইলার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগে থেকে বিদ্যমান মাতৃস্বাস্থ্য সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে, যদিও খুব কমসংখ্যক ব্যক্তিই এই বিপদ সম্পর্কে অবহিত। গর্ভবতী নারীদের চেয়েও প্রচণ্ড তাপ থেকে পোষা প্রাণীদের রক্ষার বিষয়ে বেশি তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ১০৫টি হিট সেফটি ওয়েব পেজ, ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান ও ১৫টির বেশি ঘনবসতিসহ যুক্তরাষ্ট্রের ১৮টি শহরের ধারণক্ষমতা ইত্যাদি থেকে মোট ৩২ লাখ লোকের ওপর করা এক পর্যালোচনা থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
শুধুমাত্র শিকাগো ও ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রকাশিত দু’টি নিবন্ধে গর্ভাবস্থায় তাপমাত্রার প্রভাব সম্পর্কিত বিষয় বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে। ২০২০ সালের আগস্টে পর্যালোচনাটি প্রকাশের পর নিউইয়র্ক সিটি সুরক্ষিত নয়— এমন জনসংখ্যার তালিকায় গর্ভবতী নারীদেরকে যুক্ত করে। অন্যদিকে বিভিন্ন গবেষণায় পোষা প্রাণীর ওপর তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদের উল্লেখ পাওয়া গেছে ৩৭ বার।
তাপমাত্রার ক্রমাগত বৃদ্ধি গর্ভবতী নারী ও গর্ভের ভ্রূণের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে। ২০২০ সালে হার্ভার্ডের এক গবেষণায় অতিরিক্ত তাপের সঙ্গে গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিসের সম্পর্ক দেখা গেছে। চলতি গ্রীষ্মে আমেরিকান কলেজ অব অবস্টেট্রিশিয়ানস ও গাইনোকলজিস্টের গবেষকরা চরম তাপমাত্রা ও অনিয়মিত জন্মের ফলাফলের মধ্যে সংযোগের বিষয়ে নির্দেশিকা দিয়েছেন। তারা বলছেন, এমনকি হারিকেনও (ঘূর্ণিঝড়) গর্ভবতী মায়েদের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরি করে, যা অকাল জন্মের হার বাড়িয়ে দিতে পারে।
জলবায়ু হুমকির সঙ্গে গর্ভাবস্থার যোগসূত্র মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ পরিকল্পনায় নতুন আইন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইলিনয়ের ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি লরেন আন্ডারউড এমন একটি আইন প্রবর্তন করেছেন যারা গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসায় জড়িত মেডিকেল প্রফেশনাল ও রোগীদের শিক্ষায় কাজে লাগবে।
সারাবাংলা/আরএফ
জলবায়ু পরিবর্তন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভ্রূণের ওপর প্রভাব মাতৃস্বাস্থ্য