Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নতুন আস্থা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ৪০ ভাগ চাহিদা মেটানোর পরিকল্পনা

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১০ নভেম্বর ২০২১ ১০:১১

ফাইল ছবি

ঢাকা: জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বিশ্বকে বাসযোগ্য করতে উন্নত দেশগুলো এখন বেশ সরব। বিশ্বের সম্পদশালী দেশগুলো এই জ্বালানি বন্ধে ইতোমধ্যে সময়ও বেঁধে দিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতিতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। সরকারের পরিকল্পনা, আগামী ২০ বছরের মধ্যে বিদ্যুতের ৪০ ভাগ চাহিদা মেটানো হবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। যদিও এই পরিকল্পনার কিছুই এখনও বাস্তবায়নের পথে হাঁটেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি পেতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো উৎসের ঘাটতি ও জমি সংকট। তাই উৎস হিসেবে এখন বাসা বাড়ির ছাদ এবং নদী তীরের পরিত্যাক্ত জায়গা বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

নবায়নযোগ্য জ্বালানি এমন এক শক্তির উৎস যা কম সময়ের ব্যবধানে একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। এতে ওই শক্তির উৎস শেষ হয় না। এটি পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন নিঃসরণমুক্ত। সেজন্যই বিশ্বের অনেক দেশ এখন বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ঝুঁকছে। বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌর শক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময়; পাশাপাশি রয়েছে বায়োগ্যাস ও বায়োমাস। এছাড়া বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনাও বেশ ভালো। তবে তা এখনো গবেষণাধীন। বর্তমানে দেশের ১৩টি স্থান থেকে বাতাসের উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। পানি থেকে বিদ্যুৎ, সোলার পিভি ব্যবহার করে সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ, পৌর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, গোবর ও পোল্ট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস। আরও সম্ভাবনার জায়গা হলো বাতাসের গতি, ধানের তুষ, আখের ছোবরা, বর্জ্য, শিল্ট প্রক্রিয়ার অব্যবহৃত তাপ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির এ উৎস পর্যাপ্ত নয়।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য উৎসে সোলার ছাড়া অন্য কোনো সোর্স নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে হাইড্রো প্রচুর ব্যবহার আছে। বায়ু ও জিও থার্মাল ব্যবহার করা যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এসব সোর্স আমাদের দেশে নেই। অন্যদিকে, সোলারের ক্ষেত্রে জমির স্বল্পতা রয়েছে। কৃষির জন্যও জমি দরকার। কারণ সরকার খাদ্যের দিকে জোর দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘দেশে শিল্প-কারখানা হচ্ছে। আমাদের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সেজন্য সোলার ওভাবে প্রসার করতে পারি না। সেজন্য আমরা রিওনেবলকে প্রসারের জন্য কিছু ইনোভেটিভ আইডিয়া করেছি। যেমন- সরকারি ভবনের ছাদ ব্যবহার। এছাড়া বাড়ি তৈরির সময় মালিকদের শর্ত দেওয়া হচ্ছে- বিদ্যুৎ সংযোগের পাশপাশি সোলার প্যানেল লাগাতে হবে। তারপরে চরাঞ্চলে নদী তীর, রেললাইনের পাশে এবং সেচ কাজ যেন নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে করা যায় সেদিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’

বর্তমান অবস্থা

বিদ্যুৎ খাতের জন্য তৈরি করা মহাপরিকল্পনা পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানে (পিএসএমপি) ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ যোগ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল। ২০১৬ সালের সংশোধিত পিএসএমপি অনুযায়ী পাঁচ বছর শেষ হতে চলেছে। পরিকল্পনার দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও বাস্তবায়নে এখনও বেশ পিছিয়ে। এই পাঁচ বছরে এ পর্যন্ত ৭৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে, যা মোট বিদ্যুতের ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৪২৫ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়া মোট বিদ্যুতের সৌর উৎস থেকে ৫৪২ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, হাইড্রো থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে শূন্য দশমিক ৬৯ মেগাওয়াট এবং বায়োমাস থেকে শূন্য দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ পেতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জমি সংকট।

এ নিয়ে গঠিত টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে এই উৎস নতুন। অন্যদিকে, আমাদের খাদ্যশস্যের অগ্রাধিকার রয়েছে। যে কারণে নবায়নযোগ্য শক্তি পেতে জমির একটা বড় সংকট রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ এই উৎস থেকে পাওয়ার টার্গেট রয়েছে। সে লক্ষ্যে অনেক প্রকল্প চলমান।’

চলমান উদ্যোগ

নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ২ হাজার ৫৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে চায় সরকার। সেজন্য অনেকটা জোরেশোরেই মাঠে নেমেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪ দশমিক ৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌর বিকিরণ হয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা পুরনো হলেও গত পাঁচ বছরে পরিকল্পনা মাফিক এগোতে পারেনি সরকার। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের কাপ্তাই হৃদে দেশের প্রথম পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৮ সালে এসে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫০ মেগাওয়াট কাপলান টাইপের টার্বাইন সম্বলিত চতুর্থ এবং পঞ্চম ইউনিট স্থাপন করা হয়। যাতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৩০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয় বেসরকারি উদ্যোগে। পরবর্তী সময়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করে। ১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি। এ পর্যন্ত প্রায় ৬ মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকল’র মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচির কারণে এর সংখ্যা বাড়ছে। সোলার হোম সিস্টেম একটি বিশাল এবং বিশ্বস্ত সিস্টেম। এর সফলতার জন্য অনন্য গ্রামীণ ক্রেডিট এবং ‘কস্ট বাই ডাউন’ সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রামের বাড়িগুলো কর্মসূচির আওতায় এসেছে।

এছাড়াও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এবং বিনিয়োগকারীদের সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে। সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বাংলাদেশ ব্যাংক, ইডকল এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তাছাড়া কিছু নবায়নযোগ্য জ্বালানি পণ্য যেমন- সোলার প্যানেল, সোলার প্যানেল প্রস্তুতের উপাদান, চার্জ কন্ট্রোলার, ইনভার্টার, এলইডি লাইট, সৌরচালিত বাতি এবং বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র এর ওপর সরকার শুল্ক অব্যাহতি প্রণোদনা দিচ্ছে।

সোলার হোম সিস্টেমের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সরকারি কয়েকটি কর্মসূচি যেমন- সৌর সেচ, সৌর মিনি/মাইক্রো গ্রিড, সোলার পার্ক, সোলার রুফটপ, সোলার বোটিং ইত্যাদি শুরু করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্য হল গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। যার ফলে কমবে কার্বন নিঃসরণ এবং সরকারি ভর্তুকি। ইউএনডিপি’র অর্থায়নে স্রেপজেন প্রকল্প থেকে বায়োমাস রিসোর্স ম্যাপিং সমীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এই সমীক্ষার পর দেশে বায়োমাসের সম্ভাবনার ওপর একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা

কার্বন নিঃসরণ কমাতে এরই মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে এসে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য উৎসে জোর দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে বিষয়গুলো যুক্ত করে হালনাগাদ করা হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বর্তমান বিদ্যুতের চাহিদা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ বিপর্যয় ও তেলের বাজার পরিস্থিতিও মাস্টারপ্ল্যানের বিবেচনায় থাকবে। পাশাপাশি নবায়যোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০০৮ হালনাগাদের উদ্যোগ নেওয়া, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সোলার রুফটপ সিস্টেম স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা, সোলার রেডিয়েশন রিসোর্স অ্যাসেসমেন্ট ডাটা সংগ্রহ, নেট মিটারিং গ্রাহকদের জন্য পাওয়ার ফ্যাক্টর স্টাডি, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অফসোর এবং অনসোর ভিত্তিক বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া স্রেডা’র উদ্যোগে আরও বেশ কিছু স্থানে তথ্য আহরণে প্রয়োজনীয় টাওয়ার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বায়োগ্যাস এবং বায়োমাস জ্বালানির ওপর সমীক্ষা এবং জিআইএস ম্যাপিং, পৌরবর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, ভাসমান সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগ, বাসাবাড়িতে সোলার হিটিংয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।

অন্যান্য দেশ কী করছে

ভারত নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০৩০ সালের ৪৫০ গিগাওয়াটে নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। বর্তমানে যা রয়েছে ৮৬ গিগাওয়াট। ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিটি রাজ্যে ৮ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ করতে চায় তারা। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহ বাড়াতে ভুর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে। আর যুক্তরাজ্যে ২০২০ সালে মোট উৎপাদনের ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য থেকে এসেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৬৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। এর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে সরকার। এছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে নিতে চায় জার্মানি।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের যে অবস্থা তাতে পুরোপুরি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভর করা যাবে না। অন্যান্য দেশ পারে। কারণ তাদের সাপ্লিমেন্ট আছে। একটা আরেকটাকে সাপোর্ট করে। সোলারকে বায়ু সাপোর্ট করে, হাইড্রো সাপ্লিমেন্ট করে। যখন দিনের আলো থাকে না তখন তারা হাইড্রো দিয়ে রাত কভার করে। বাংলাদেশে সোলার ছাড়া আর কিছু নেই। যে কারণে দিনের আলো শেষ হয়ে গেলে আর কোনো সুযোগ থাকবে না। সে জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে অবশ্যই আমরা গুরুত্ব দেবো, তবে জীবাশ্ম জ্বালানিকে বাদ দিয়ে নয়।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে যেসব এলাকায় গ্রিড বিদ্যুৎ দিতে পারিনি সেসব স্থানে সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রিডে বিদ্যুৎ দিতে না পারব ততক্ষণ সোলার আলো দিয়ে বিদ্যুতায়িত করার চেষ্টা করছি। আমরা ৫৫ লাখ সোলারের মাধ্যমে ২ কোটি মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধা দিতে পেরেছি।’

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

জীবাশ্ম জ্বালানি নবায়নযোগ্য জ্বালানি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর