আহসানউল্লাহ থেকেই প্রশ্নফাঁস, লেনদেন ৬০ কোটি: ডিবি
১০ নভেম্বর ২০২১ ১৭:০৭
ঢাকা: বেসরকারি আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগ থেকে সমন্বিত ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির আইসিটি বিভাগে কর্মরত মোকতারুজ্জামান রয়েল।
পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় তিনি প্রথমে প্রশ্নপত্র তুলে দেন জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখায় কর্মরত সামসুল হক শ্যামলের হাতে। এরপর তিনি বাকি সদস্যদের হাতে প্রশ্নপত্রসহ উত্তরপত্র তুলে দেন। আর এভাবেই এবারের একটি পরীক্ষাসহ মোট চারটি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা স্বীকার করে গ্রেফতাররা। হাতিয়ে নেয় অন্তত ৬০ কোটি টাকা।
বুধবার (১০ নভেম্বর) বিকেল ৪টায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের মূল হোতা পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর সাংবাদিকদের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
আরও পড়ুন: সমন্বিত ব্যাংকের নিয়োগে ‘প্রশ্নফাঁস’, পরীক্ষা বাতিলের দাবি
ডিবি প্রধান বলেন, গত ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের অফিসার ক্যাশ পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ডিবি জানতে পারে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর। সেই অনুযায়ী আগের দিন সন্ধ্যায় ডিবির একটি টিম ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সেজে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রাইসুল ইসলাম নামে ওই ব্যক্তি প্রশ্নপত্র দেওয়ার কথা নিশ্চিত করেন। এজন্য তাকে ডিবি কর্মকর্তা ৫০ হাজার টাকাও প্রদান করে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষার দিন (৬ নভেম্বর) সকাল ৭টার দিকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে হাজির হয়। সেখানে কোচিং স্টাইলে ৮৫টি প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করায়। এরপর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী স্বপনকে হেফাজতে নেয় ডিবি।
স্বপনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এই চক্রের বিষয়ে সন্ধান দেয়। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখায় কর্মরত অফিসার সামসুল হক শ্যামলকে হেফাজতে নেওয়া হয়। শ্যামলের দেওয়া তথ্যমতে, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা থেকে মোস্তারুজ্জামান রয়েল এবং পূবালী ব্যাংকের লালবাগ শাখায় কর্মরত সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলনকে গ্রেফতার করা হয়। মিলনের তথ্যমতে ঢাকার সাভার থেকে রুপালী ব্যাংকের নবীনগর শাখায় কর্মরত জানে আলম মিলনকে গ্রেফতার করা হয়।
হাফিজ আক্তার বলেন, পরীক্ষার দিন সকালে রাজধানীর বাড্ডা, গুলশান, তেজগাঁও, লালবাগ, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, ডেমরা ও পুরান ঢাকা এলাকায় বুথ তৈরি করে টাকা নেওয়া শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র দিযে উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। একেকটি বুথে ২০০ জনের তালিকা উদ্ধার করেছে ডিবি। গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা একেকজনের কাছ থেকে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা চুক্তিতে অগ্রিম ২০ শতাংশ হারে টাকা নিয়েছে। এবারে অন্তত দুই হাজার জনের কাছ থেকে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
আরও পড়ুন: ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে আটক ১০
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছে, এবার নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াও পুর্বে আরও তিনটি পরীক্ষায় তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছিল। সেই প্রশ্নপত্র দিয়ে গ্রেফতারদের অনেকের চাকরি হয়েছে। চাকরি পেয়ে তারাও একই কাজে নেমেছে। এখানে মূল ভূমিকা পালন করেছে আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগে কর্মরত মোক্তারুজ্জামান রয়েল। তাকে সহযোগিতা করেছে শ্যামল, জানে আলম আর মিলন। স্বপন এখানে লোকজন ও টাকা সংগ্রহ করেন। এই চক্রের আরও ২০ থেকে ২৫ জন সদস্য রয়েছে বলে জানতে পেরেছে ডিবি। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কেউ জড়িত থাকে তাহলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে হাফিজ আক্তার বলেন, ‘গত ৬ নভেম্বর বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে অনুষ্ঠিত ৫টি ব্যাংকের ১৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ শূন্য পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে সোনালী ব্যাংক ১৮৩টি, জনতা ব্যাংক ৫১৬টি, অগ্রণী ব্যাংক ৫০০টি, রূপালী ব্যাংক ৫টি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ৭টি পদ রয়েছে। বিকেল ৩টা হতে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহসানুল্লাহ ইউনির্ভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, ‘আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ল কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ রয়েছে, নিম্ন কোটেশনে তারা প্রতিবার পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থাপনার টেন্ডার পেয়ে থাকেন। আমরা সেই বিষয়টিও তদন্তের আওতায় নিয়ে আসব। প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যে কেউ জড়িত থাকুক না কেন আমরা সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।’
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি প্রথম দিন থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। অথচ আপনারা হাতেনাতে ধরলেন, এখন বাংলাদেশ বা ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি কি বলছেন? আপনারা কি তাদের বিষয়টি অবহিত করেছেন? জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, ‘এরইমধ্যে আমরা বিষয়টি ওনাদের জানিয়েছি। তারা সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছেন। তারা জানিয়েছেন প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ওই পরীক্ষায়। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, ‘যাদের সাথে চুক্তি হয় তাদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র দেওয়ার আগে ২০ শতাংশ টাকা নেওয়া হয়ে থাকে। লিখিত পরীক্ষার আগে ২০ শতাংশ টাকা নেওয়া হয় এবং ভাইভার পর বাকি টাকা নেওয়া হয়ে থাকে।’
এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় একটি ডিজিটাল আইনে মামলা করা হয়েছে। মামলায় ৫ জনকে গ্রেফতার দেখিযে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত শেষে একটি মানিলন্ডারিং মামলাও হবে।
ডিবি জানিয়েছে, জনতা ব্যাংকের অফিসার সামসুল হক শ্যামল পূবালী ব্যাংকের লালবাগ শাখায় কর্মরত মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের হাতে প্রশ্নপত্রসহ উত্তরপত্র তুলে দেন। রূপালী ব্যাংকের নবীনগর শাখায় কর্মরত জানে আলম মিলনের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেন। এরপর ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী স্বপনের হাতে প্রশ্নপত্র চলে যায়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরও অনেক জড়িত রয়েছেন। তদন্তে দোষের মাত্রা অনুযায়ী আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। মামলায় আটক হওয়া দুজনকে সাক্ষী বানানো হয়েছে। উদ্ধার হওয়া প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্রসহ মোবাইল ফোনে পাঠানো মেসেজেও জব্দ করা হয়েছে। সঙ্গে ৬ লাখ টাকাও উদ্ধার দেখানো হয়েছে।
জানতে চাইলে অভিযানকারী কর্মকর্তা ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ কমিশনার শাহাদাত হোসেন সোমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরীক্ষার দিন থেকে প্রায় ৮০ ঘণ্টার অপারেশন চালানো হয়েছে। দিনাজপুর, জামালপুর, সাভার, ঢাকার অলিগলি অভিযান চালানো হয়েছে। গ্রেফতার ব্যাংক কর্মকর্তাদের তিনজনই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পেয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। এর পেছনে আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন জড়িত রয়েছে জানা গেছে।’
বুধবার (১০ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা বাতিল করেনি বলে জানা গেছে।
সারাবাংলা/ইউজে/একে