Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘পুলিশ যেন ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেয়’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১১ নভেম্বর ২০২১ ১৭:৪৫

মামলার রায়ের পর আদালত থেকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বেরিয়ে আসছেন আসামি সাফাত, নাঈমসহ অন্যরা [ছবি- সারাবাংলা]

ঢাকা: ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে আলামত পাওয়া যায় না উল্লেখ করে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে ধর্ষণের মামলা না নিতে পুলিশকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের মামলার রায় ঘোষণার পর পর্যবেক্ষণে আদালত এ কথা বলেন।

বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের আদালত আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামিকে খালাস পেয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

মামলার রায় ঘোষণার পর বিচারক বলেন, ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা দায়ের করা হয়েছে। ৩৯ দিন পর ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়। ধর্ষণের শিকার তরুণীদের পোশাকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। ধর্ষণ প্রমাণে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন প্রয়োজন। সেটিও প্রমাণিত হয়নি। তারপরও এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা প্রকাশ্য আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন।

আরও পড়ুন- রেইনট্রি ধর্ষণ মামলা: সাফাতসহ ৫ আসামি খালাস

পর্যবেক্ষণে বিচারক আরও বলেন, ঘটনার দিন তারা (মামলার বাদী দুই তরুণী) আসামিদের সঙ্গে এক বিছানায় শুয়েছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভিকটিমদের ডাক্তারি রিপোর্টে কোনো সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের বিবরণ নেই। ভিকটিমের পরিধেয়তে (পোশাক) পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিললো না। ৩৮ দিন পর এসে তারা বললো, ‘রেপড হয়েছি’। বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল।

রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ের আগে সাফাত, নাঈমসহ ৫ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয় [ছবি- সারাবাংলা]

রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ের আগে সাফাত, নাঈমসহ ৫ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয় [ছবি- সারাবাংলা]

এই অভিযোগপত্র দাখিলের মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তা ‘আদালতের সময় নষ্ট করেছেন’ বলেও মন্তব্য করেন বিচারক। তিনি বলেন, ভিকটিমের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক থাকলেও ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ডাক্তারি পরিক্ষায় কুমারী মেয়ের যে আলামত, সেটি প্রমাণ হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে আদালত ও পাবলিক টাইম নষ্ট হয়েছে। এ বিষয়ে আমার একটি পর্যবেক্ষণ আছে— ৭২ ঘণ্টা বা এর একটু কম সময় পার হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। এরকম হলে পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে কোনো ধর্ষণের মামলা না নেয়।

বিজ্ঞাপন

বিচারক রায়ে বলেন, হোটেল রেইনট্রিতে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। সেখানে ‘দুই পক্ষের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক’ ঘটেছে। ধর্ষণের কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

আরও পড়ুন- ২ শিক্ষার্থী ধর্ষণ: সাফাতসহ ৫ জনের যাবজ্জীবন চায় রাষ্ট্রপক্ষ

এই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন সাফাত আহমেদ। মামলার বাকি আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাফাতের দুই বন্ধু সাদমান সাকিফ ও নাঈম আশরাফ। বাকি দুই আসামি হলেন— সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল।

এদিন আদালতে রায় ঘোষণার সময় পাঁচ আসামির সবাই উপস্থিতি ছিলেন। রায় ঘোষণার পর আদালত ত্যাগ করার সময় তাদের উল্লসিত দেখা যায়।

রায় ঘোষণার পর মামলার অন্যতম আসামি নাঈম আশরাফের আইনজীবী এম এ বি খায়রুল ইসলাম (লিটন) বলেন, বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী মডেল পিয়াসা ষড়যন্ত্র করে উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসীদের কাছে সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেনকে হেনস্তা করার জন্য এই ঘটনার ১ মাস ৮ দিন পরে মামলাটি দায়ের করিয়েছেন। আদালত মামলার মেডিকেল রিপোর্ট, ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আসামিদের দেওয়া জবানবন্দি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় ভিকটিমের জবানবন্দি এবং ২২ জন সাক্ষীর জবানবন্দিসহ সব দিক বিবেচনা ও পর্যালোচনা করে আসামিদের খালাস দিয়েছেন।

আরও পড়ুন- রেইনট্রি ধর্ষণ মামলায় সাফাতসহ ৫ আসামির সর্বোচ্চ সাজা দাবি

আইনজীবী এম এ বি খায়রুল আরও বলেন, আসামিদের সঙ্গে ভিকটিমদের ডিএনএ ম্যাচ করেনি। ৯৪ কর্মদিবসে মামলাটির রায় রয়েছে। ৯৩ কার্যদিবসে মিথ্যা মামলায় আদালতের সময় নষ্ট হয়েছে বলে বিচারক উল্লেখ করেছেন। ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার পরে ডাক্তারি পরীক্ষায় আলামত প্রমাণের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। তাই ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পার হলে যেন পুলিশ ধর্ষণের মামলা না নেয়, সে বিষয়ে তিনি (বিচারক) সুপারিশ করবেন বলেও জানিয়েছেন।

রেইনট্রিতে ধর্ষণের অভিযোগ: মামলা দায়ের থেকে রায়

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে সাফাত আহমেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে ওই দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। ৩৮ দিন পর ওই বছরের ৬ মে রাজধানীর বনানী থানায় মামলাটি দায়ের করেন ধর্ষণের শিকার এক তরুণী। মামলায় অভিযোগ করেন, রেইনট্রি হোটেলের রুমে তাদের বন্দি করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা হয়। সাফাত ও নাঈম ধর্ষণ করেন তাদের। বাকি তিন আসামি তাদের ধর্ষণের সহায়তা করেন বলে এজাহারে বলা হয়।

মামলাটি সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। মামলা দায়েরের ৬ দিনের মাথায় সিলেটে গ্রেফতার হন সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ। পরে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাকি তিন আসামিকেও গ্রেফতার করা হয়।

রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বেরিয়ে যান সাফাত, নাঈমসহ ৫ আসামি [ছবি- সারাবাংলা]

রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বেরিয়ে যান সাফাত, নাঈমসহ ৫ আসামি [ছবি- সারাবাংলা]

আলোচিত মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমিকে। মামলা দায়েরের মাসখানেক পর ২০১৭ সালের ৭ জুন তিনি সাফাত, নাঈমসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন আদালতে। অভিযোগপত্রে আসামি সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিমের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। বাকি তিন আসামি সাদমান সাকিফ, রহমত আলী ও বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে একই আইনের ৩০ ধারায় ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ করা হয়।

অভিযোগপত্র দাখিলের এক বছরেরও বেশি সময় পর ২০১৮ সালের ১৯ জুন আসামিদের বিরুদ্ধ অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আদালত। এর মাসখানেক পর ১৩ জুলাই একই ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু করেন।

সংশ্লিষ্ট আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ মামলায় ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন আদালত। তবে মামলার গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষী আহমেদ শাহরিয়ার ও ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা সাক্ষ্য দেননি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, আদালত থেকে বারবার সমন পাঠানো হলেও এ দু’জন সাক্ষ্য দিতে হাজির হননি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে অন্যান্য মামলার মতো এ মামলাটির কার্যক্রমও স্থবির হয়ে যায়। পরে সশরীরে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে ফের মামলাটি সচল হয়। সবশেষ গত গত ২৯ অগাস্ট মামলার আত্মপক্ষ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেন। ওই সময় তারা সবাই জামিনে থাকলেও যুক্তিতর্ক শেষে গত ৩ অক্টোবর তাদের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়।

ওই দিনই রেইনট্রি ধর্ষণ মামলার রায়ের জন্য ১২ অক্টোবর দিন নির্ধারণ করে দেন আদালত। রায় তৈরি না হওয়ায় সেটি পিছিয়ে ২৭ অক্টোবর ঘোষণার নতুন তারিখ জানান বিচারক। তবে প্রবীণ আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে ২৭ অক্টোবর নিম্ন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকলে আরও এক দফা পিছিয়ে যায় এই মামলার রায়। সেদিন রায় ঘোষণার জন্য ১১ নভেম্বর দিন ঠিক করে দিয়েছিলেন আদালত। মামলা দায়েরের সাড়ে চার বছরের মাথায় এসে মামলাটির রায় ঘোষণা হলো।

সারাবাংলা/এআই/টিআর

আপন জুয়েলার্স দুই তরুণীকে ধর্ষণ ধর্ষণ মামলার রায় নাঈম আশরাফ বিচারক কামরুন্নাহার বিল্লাল হোসেন রহমত আলী রায়ের পর্যবেক্ষণ রেইনট্রি ধর্ষণ মামলা রেইনট্রিতে ধর্ষণ সাদমান সাকিফ সাফাত আহমেদ হোটেল রেইনট্রি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর