ঢাকা: রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত। এ রায়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন মামলার বাদী দুই শিক্ষার্থীর পরিবার। সংক্ষুদ্ধ রাষ্ট্রপক্ষ ও বাদীপক্ষের আইনজীবীও। তবে রায়ে উল্লাস দেখা গেছে আসামিপক্ষে। রায় ঘোষণার পর উল্লসিত অবস্থায় আদালত থেকে বের হতে দেখা গেছে সাফাত আহমেদসহ বাকি আসামিদের।
বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) বিকেলে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিচারক বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার সব আসামিকে খালাস দেওয়া হলো।
এই মামলায় আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে সাফাত আহমেদের সঙ্গে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন তার বন্ধু নাঈম আশরাফ। অন্যদিকে সাফাতের আরেক বন্ধু সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ধর্ষণে সহায়তা করার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল তাদের সবাইকেই খালাস দিয়েছেন।
আরও পড়ুন- ‘পুলিশ যেন ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেয়’
মামলার রায় ঘোষণার পর বাদী পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘এই মামলার রায়ের পর একজন ভিকটিমের মায়ের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তিনি রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন তিনি। আমি উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।’
রায় সম্পর্কে ফারুক আহাম্মদ জানান, ট্রাইব্যুনালের রায়ে এটি প্রমাণিত হয়েছে— মামলাটি মিথ্যা নয়। মিথ্যা হলে ট্রাইব্যুনাল বাদীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় প্রসিকিউশন দাখিলের নির্দেশ দিতেন। মূলত সঠিক তদন্ত না হওয়ায় আজ এমন রায় হলো। এ কারণে আদালত মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনাও করেছেন। ঘটনার অনেক দিন পর ডাক্তারি পরীক্ষা হওয়ায় স্বভাবিকভাবে ধর্ষণের আলামত আসবে না। তাই এ মামলায় পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সাক্ষী ও আসামিদের স্বীকারোক্তিই ভরসা ছিল।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছিলেন, তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভিকটিমদের ডাক্তারি রিপোর্টে কোনো সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের বিবরণ নেই। ভিকটিমের পরিধেয়তে (পোশাক) পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিললো না। ৩৮ দিন পর এসে তারা বললো, ‘রেপড হয়েছি’। বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল। তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে আদালত ও পাবলিক টাইম নষ্ট হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে যেন পুলিশ মামলা না নেয়, সে বিষয়েও ‘পরামর্শ’ দেন বিচারক।
আরও পড়ুন- রেইনট্রি ধর্ষণ মামলা: সাফাতসহ ৫ আসামি খালাস
এদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এই রায়ে সংক্ষুব্ধ রাষ্ট্রপক্ষও। সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি। অভিযোগ প্রমাণে আমাদের কোনো গাফিলতি ছিল না। তারপরও আদালত আসামিদের খালাসের আদেশ দিয়েছেন। এ রায়ে আমরা সংক্ষুদ্ধ।
আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ হলেও এই রায়ে আসামিরা ন্যায় বিচার পেয়েছেন বলে মনে করছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। তিনি বলেন, ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিক্তিতে আদালত চূড়ান্তভাবে রায় ঘোষণা করেছেন। আসামিদের খালাস দিয়েছেন। আমরা প্রথম থেকেই বলছিলাম— বাদীপক্ষের অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরবর্তী সময়ে যারা প্রসিকিউশন করেছেন, সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে এনেছেন— তারাও অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি। ২২ জন সাক্ষী হাজির করা হয়। পরে মেডিকেল রিপোর্ট, ডিএনএ রিপোর্ট, ভিকটিমের জবানবন্দি— সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই আদালত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, মামলাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য আদালত তাদের খালাস দিয়েছেন।
মোশাররফ হোসেন কাজল আরও বলেন, এই মামলার তদন্ত দল মামলা তদন্তে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মামলাটি গ্রহণ করার পর থেকে তারা যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, আমরা বিস্মিত হয়েছি। তাদের ব্যর্থতায় আদালত বলেছেন— এই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা উচিত ছিল। কিন্ত তারা কাউকে খুশি করার জন্য এ কাজ (অভিযোগপত্র দাখিল) করেছিলেন।
আরও পড়ুন- ২ শিক্ষার্থী ধর্ষণ: সাফাতসহ ৫ জনের যাবজ্জীবন চায় রাষ্ট্রপক্ষ
মামলার আরেক আসামি নাঈম আশরাফের আইনজীবী এম এ বি খায়রুল ইসলাম (লিটন) বলেন, বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী মডেল পিয়াসা ষড়যন্ত্র করে উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসীদের কাছে সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেনকে হেনস্তা করার জন্য এই ঘটনার ১ মাস ৮ দিন পরে মামলাটি দায়ের করিয়েছেন। আদালত মামলার মেডিকেল রিপোর্ট, ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আসামিদের দেওয়া জবানবন্দি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় ভিকটিমের জবানবন্দি এবং ২২ জন সাক্ষীর জবানবন্দিসহ সব দিক বিবেচনা ও পর্যালোচনা করে আসামিদের খালাস দিয়েছেন।
এই আইনজীবী আরও বলেন, আসামিদের সঙ্গে ভিকটিমদের ডিএনএ ম্যাচ করেনি। ৯৪ কর্মদিবসে মামলাটির রায় রয়েছে। ৯৩ কার্যদিবসে মিথ্যা মামলায় আদালতের সময় নষ্ট হয়েছে বলে বিচারক উল্লেখ করেছেন। ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার পরে ডাক্তারি পরীক্ষায় আলামত প্রমাণের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। তাই ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পার হলে যেন পুলিশ ধর্ষণের মামলা না নেয়, সে বিষয়ে তিনি (বিচারক) সুপারিশ করবেন বলেও জানিয়েছেন।
২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে সাফাত আহমেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে ওই দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয় বলে আলোচিত এই মামলায় অভিযোগ করা হয়। ৩৮ দিন পর ওই বছরের ৬ মে রাজধানীর বনানী থানায় মামলাটি দায়ের করেন ধর্ষণের শিকার এক তরুণী। এর ৬ দিনের মাথায় সিলেটে গ্রেফতার হন সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ। কয়েকদিনের মধ্যেই বাকি তিন আসামিকেও গ্রেফতার করা হয়।
আরও পড়ুন- রেইনট্রি ধর্ষণ মামলায় সাফাতসহ ৫ আসামির সর্বোচ্চ সাজা দাবি
আলোচিত মামলাটি তদন্ত করেন পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পরিদর্শক ইসমত আরা এমি। ২০১৭ সালের ৭ জুন তিনি অভিযোগপত্র দাখিল করেন আদালতে। অভিযোগপত্রে সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিমের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। বাকি তিন আসামি সাদমান সাকিফ, রহমত আলী ও বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে একই আইনের ৩০ ধারায় ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ করা হয়।
২০১৮ সালের ১৯ জুন আসামিদের বিরুদ্ধ অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আদালত। ১৩ জুলাই একই ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু করেন। এ মামলায় ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন আদালত। তবে মামলার গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষী আহমেদ শাহরিয়ার ও ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা সাক্ষ্য দেননি।
সবশেষ গত গত ২৯ অগাস্ট মামলার আত্মপক্ষ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তিতর্ক শেষে গত ৩ অক্টোবর আসামিদের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়। একইসঙ্গে মামলার রায়ের জন্য ১২ অক্টোবর দিন নির্ধারণ করে দেন আদালত। রায় তৈরি না হওয়ায় সেটি পিছিয়ে ২৭ অক্টোবর ঘোষণার নতুন তারিখ জানান বিচারক। তবে প্রবীণ আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে ২৭ অক্টোবর নিম্ন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকলে আরও এক দফা পিছিয়ে যায় এই মামলার রায়। সেদিন রায় ঘোষণার জন্য ১১ নভেম্বর দিন ঠিক করে দিয়েছিলেন আদালত। মামলা দায়েরের সাড়ে চার বছরের মাথায় এসে মামলাটির রায় ঘোষণা হলো।