আলাদা মন্ত্রণালয় নয়, সমুদ্র রক্ষায় দরকার আরও বেশি কাজ
১১ নভেম্বর ২০২১ ২২:৫১
ঢাকা: বঙ্গোপসাগর নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। আমাদের অনেক বেশি কাজ করা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এ সময় তিনি সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। গবেষণা বাড়োনো গেলে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর থেকে অনেক সম্পদ অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশে সমুদ্র পরিবেশ নিয়ে কাজ করা একমাত্র সংগঠন সেভ আওয়ার সি- কর্তৃক আয়োজিত ‘নীল অর্থনীতি: সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গেলটেবিল আলেচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলো ফাজিতাস এবং লুলু শপ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আরও বলেন, ‘সুন্দরবন একসময় কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অযত্ন ও পরিকল্পনার অভাবে এখন অনেক ছোট হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে কাজ করতে আন্তরিক। সাগর নিয়ে বেসরকারি সংগঠনগুলো এগিয়ে এলে সরকার সহযোগিতা করতে চায়।’
এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশ্বস্ত করতে চাই সমুদ্র অর্থনীতি ও পরিবেশ নিয়ে সেভ আওয়ার সি-সহ বিভিন্ন সংগঠন যে আগ্রহ দেখিয়েছে আমরা সেটি বাস্তবায়নে অনেক আগ্রহী।’
সেভ আওয়ার সি’র সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ আনোয়ারুল হকের সঞ্চালনায় আয়োজিত এই গোল টেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশেনোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দীন মুন্না। এতে তিনি বাংলাদেশের আগামীর অর্থনীতিতে সাগরের গুরুত্ব তুলে ধরেন। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগের সংকট, সমুদ্রের ব্যাবহারবিধি না জানায় এখনও সমুদ্র আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। কিংবা যেটুকু ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে সঠিকভাবে জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্লু ইকোনমির নামে বর্তমানে যেসব প্রকল্প হচ্ছে অধিকাংশই সমুদ্রবিরোধী বলে উল্লেখ করে পরিবেশ ও সমুদ্রবান্ধব সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয় মূল প্রবন্ধে। সমুদ্র সম্পর্কে দেশে ব্যাপক জ্ঞানের ব্যাপক সংকট রয়েছে জানিয়ে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার কারিকুলামে সমুদ্রশিক্ষাকে যুক্ত করার দাবি তুলে ধরা হয়।
সাগর বিষয়ক পাঠ্যসূচি তৈরির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চান দেশের সব সম্পদ সম্পর্কে যেন শিশুরা জানতে পারে।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘সমুদ্রে টাইডাল এনার্জি, নানারকম খনিজ সম্পদ ও মৎস্যসহ অনেক সম্পদ থাকায় এখানে সম্ভাবনা অনেক বেশি। সমুদ্র আমাদের জন্য যেমন সম্ভাবনার তেমন আতঙ্কেরও। সমুদ্র থেকে আসা দুর্যোগ আমাদের জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি বয়ে আনে। সেই পরিস্থিতিতে আমাদের একমাত্র রক্ষা করতে পারে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। কিন্তু আমরা ওশান ইকোনমি নিয়ে যতটা বলি, ওশান ও কোস্টাল ইকোলজি নিয়ে তেমন একটা বলি না। সিডর, আইলার মতো দুর্যোগ এলেই শধু আমাদের সুন্দরবনের কথা মনে পড়ে। অন্য সময়ও আমাদের উপকূলীয় বন ও উপকূলকেন্দ্রীক ইকোসিস্টেম নিয়ে কথা বলা ও একে ধরে রাখা দরকার।’
দূষণে সমুদ্র ক্লান্ত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সারাদেশের সব বর্জ্যের গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সমুদ্র। সবচেয়ে বেশি সমস্যা প্লাস্টিক দূষণ।’ তাই প্লাস্টিক দূষণের জন্য দূষণকারীদের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়, সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণ এবং কাজে লাগাতে সব প্রতিষ্ঠানের সমস্বয়ে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির দাবি জানান তিনি।
আরও একজন বিশেষ অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশেনোগ্রাফি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কে এম আজম চৌধুরী বলেন, ‘সমুদ্র এবং উপরিভাগ নিয়ে যেই উদ্যোগই আমরা নেই না কেন, সমুদ্র এবং জলবায়ুর ক্ষতির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে অবশ্যই। সমুদ্র থেকে আয় করতে হলে গভীর সমুদ্রে গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সে জন্য সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা।’
বিশেষ অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সন্তুস কুমার দেব বলেন, ‘আমাদের যে সমুদ্র সৈকতগুলো রয়েছে সেগুলোকে যদি আমরা যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরতে পারি তাহলে বিশ্ব পার্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ খুব একটা কঠিন নয়। এ জন্য প্রয়োজন যথাযথ ও টেকসই উদ্যোগ।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিটাইম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড স্ট্যাটিজিক স্টাডিস ডিপার্টমেন্টের প্রধান কমোডর ওয়াহিদ হাসান কুতুবুদ্দিন (এনডিসি) বলেন, ‘আমাদের দেশের সমুদ্র সম্পদ আহরণের বিষয়ে যেমন উদ্যোগ নেই, তেমনি আবার যেসব কাজ হচ্ছে তার কোনো সমন্বয় নেই। কোনো ডাটাবেজ না থাকায় কাজের গতিও আসছে না। এ ছাড়া গবেষকরা কাজ করার জন্য তেমন লজেস্টিক সাপোর্টও নেই।’
সেভ আওয়ার সি-এর পরিচালক মেরিন এক্সপ্লেরার এস এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা জানি গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। এ জন্য আমরা নিয়মিত উপরিভাগে গাছ লাগাই। কিন্তু আমরা জানি না অক্সিজেনের ৭০ শতাংশ আসে সমুদ্রের উদ্ভিদ থেকে। অথচ আমরা সমুদ্রের উদ্ভিদ রক্ষা তো দূরের কথা উল্টো দূষণের মাধ্যমে নষ্ট করছি। আমরা উপরে গাছ লাগাতে কোটি কোটি টাকা ব্যায় করলেও সমুদ্রে নিচের উদ্ভিদ রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বন অধিদফতরের সহকারী প্রধান বন সংরক্ষক ড. মরিয়ম আকতার, বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের উপপরিচালক (অপারেশন) এম নূর-উজ জামান, সেভ আওয়ার সি-এর পরিচালক, মেরিন এক্সপ্লোরার এসএম আতিকুর রহমান, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, নোঙর এর সভাপতি সুমন শামস প্রমুখ।
সারাবাংলা/আরএফ/