সৌরবিদ্যুতের অগ্রগতি যথেষ্ট নয়, গ্রিডে যাচ্ছে মাত্র ১৯৫ মেগাওয়াট
১৪ নভেম্বর ২০২১ ০৮:৩৩
ঢাকা: গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে কয়লার ব্যবহার হ্রাস করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য উৎসে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। আর নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার অন্যতম উৎস হলো সৌরশক্তি। সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করেছে। এছাড়া জোরেশোরে কাজ চলছে আরও কয়েকটির। এর বাইরে একটি বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনাও রয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরে বিদ্যুৎ খাতে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুতের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রধান উৎস হচ্ছে- সৌর শক্তি, হাইড্রো, বায়োগ্যাস, বায়োমাস, জিয়োথারমাল, ওয়েভ এবং টাইডাল এনার্জি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উৎস হচ্ছে সৌর শক্তি। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এ পর্যন্ত ৫৪২ দশমিক ৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। যার সিংহভাগই এসেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অফগ্রিড এলাকায় স্ট্যান্ড অ্যালোন হিসেবে স্থাপিত সোলার হোম সিস্টেম থেকে। সরকারের লক্ষ্য ও পরিকল্পনার তথ্য বলছে, এই অগ্রগতি যথেষ্ট না। এই উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখনও বেশ পিছিয়ে। সামগ্রিক ২৫ হাজার বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন মাত্র ১৯৫ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ বিভাগের সুত্র অনুযায়ী, ২০১০ সালে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো- অপারেশন এজেন্সির (জাইকার) অর্থায়নে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা করেছিল সরকার। ওই পরিকল্পনায় ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে দেশের মোট বিদ্যুতের ১০ ভাগ উৎপাদনের কথা ছিল। যদিও তিন ভাগের বেশি উৎপাদন সম্ভব হয়নি। এর জন্য জমি সংকটকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রতি মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিন একরের বেশি জমির প্রয়োজন। যে কারণে বড় আকারের সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমির সংস্থান করা কঠিন।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ পরিস্থিতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। যে কারণে আমাদের বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা হালনাগাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যানে বড় পরিবর্তন, কয়লা থেকে সরে আসা। দ্বিতীয় হলো- নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দেওয়া। আমরা এরই মধ্যে যেসব এলাকায় গ্রিড বিদ্যুৎ দিতে পারিনি সেসব স্থানে সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রিড বিদ্যুৎ না দিতে পারব ততক্ষণ সোলার আলো দিয়ে বিদ্যুতায়িত করার চেষ্টা করেছি। এরই মধ্যে সরকার ৫৫ লাখ সোলারের মাধ্যমে ২ কোটি মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধা দিতে পেরেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এখানে সোলার ছাড়া অন্য কোনো সোর্স নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে হাইড্রোর প্রচুর ব্যবহার থাকে। বায়ু, জিও থার্মাল ব্যবহার করা যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এছাড়াও রয়েছে বায়োমাস। তবে এসব সোর্স আমাদের দেশে নেই। অন্যদিকে, সোলারের ক্ষেত্রে জমির স্বল্পতা রয়েছে। কৃষির জন্য জমি দরকার। কারণ সরকার খাদ্যের দিকে জোর দিয়েছে। অন্যদিকে, শিল্প কারখানা হচ্ছে। আমাদের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে সোলার ওভাবে প্রসার করতে পারি না। সেজন্য আমরা রিওনেবলকে প্রসারের জন্য কিছু ইনোভেটিভ আইডিয়া করেছি। সরকারি ভবনের ছাদ ব্যবহার, পাশাপাশি বাড়ি তৈরির সময় মালিকদের শর্ত দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগের পাশপাশি সোলার প্যানেল লাগানো। তারপরে চরাঞ্চলে নদী তীর, রেল লাইনের পাশে এবং সেচ কাজ যেন নবায়নযোগ্য থেকে করা যায় সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে, সৌর বিদ্যুৎকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার ২৮ টি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। এসব কেন্দ্রের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছিলো ১ হাজার ৬২৭ দশমিক ৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতায় এর মধ্য থেকে ৫৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি কেন্দ্র বাতিল করা হয়েছে। আর এখন পর্যন্ত পরিকল্পনায় থাকা কেন্দ্রের মধ্যে উৎপাদনে এসেছে মাত্র ছয়টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলোর মধ্যে টেকনাফের জুলহাস পাওয়ার লিমিটেডের ২০ মেগাওয়াট, পঞ্চগড়ের পেরোসোল এনার্জি লিমিটেডের ৮ মেগাওয়াট, কাপ্তায়ে পিডিবির ৭ দশমিক ৪ মেগাওয়াট, জামালপুরের এনগ্রিন সরিষাবাড়ির ৩ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহের মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের যৌথ প্রতিষ্ঠান এইচডিএফসি সিনপাওয়ার লিমিটেডের ৫০ মেগাওয়াট এবং সিরাজগঞ্জের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ৭ দশমকি ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
তবে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খবর দিতে পারেনি পিপিএ সই করা আরও আট প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের হাওর বাংলার ৩২ মেগাওয়াট একটি। এটির মেয়াদ চলতি বছরে শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৪৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ফলে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এছাড়া রংপুরের গঙ্গাচরায় ইন্ট্রাকো সিএনজি লিমিটেডের ৩০ মেগাওয়াট প্রকল্পেরও মেয়াদ শেষ। এটি বাস্তবায়নে ৬৫০ একর জমির প্রয়োজন। যার মধ্যে ৬২৭ একর অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। লালমনিরহাটের পাটগ্রামে গ্রিন হাউজিং অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেডের ৫ মেগাওয়াট প্রকল্পটি দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পরে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
আর সিলেটের সান সোলার পাওয়ারের ৫ মেগাওয়াট প্রকল্পটিও দীর্ঘদিন স্থগিত ছিল। বাগেরহাটের এনারগোন টেকনোলজিস’র ১০০ মেগাওয়াট প্রকল্পের দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়ে এখন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পঞ্চগড়ের বেক্সিমকো পাওয়ার লিমিটেডের ৩০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া গাইবান্ধার বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানির ২০০ মেগাওয়াট, মানিকগঞ্জের স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে আসার সময় সীমা এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে। তাই এগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
এর বাইরে আরও ৩৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো- পঞ্চগড়ে ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাবনায় ১০০ মেগাওয়াট, দেবীগঞ্জে ২০ মেগাওয়াট, মৌলভীবাজারে ১০ মেগাওয়াট, নীলফামারীতে ৫০ মেগাওয়াট, ধামরাইয়ে ৫০ মেগাওয়াট, চাঁদপুরে ৭ মেগাওয়াট, বেড়া উপজেলার ৩ দশমিক ৭৭ মেগাওয়াটের প্রকল্প। সেগুলো কবে চালু হবে তা এখনও ঠিক করা হয়নি।
বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৭৭৬ দশমিক ৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে ৫৪২ দশমিক ৩২ মেগাওয়াট আসছে সৌর শক্তি থেকে। এর ১৯৪ দশমিক ৯৫ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। বায়ু থেকে আসছে ২ দশমকি ৯ মেগাওয়াট, গ্রিডে যোগ হচ্ছে দশমিক ৯ মেগাওয়াট। হাইড্রো থেকে ২৩০ মেগাওয়াট আসছে। যার পুরোটাই গ্রিডে যোগ হচ্ছে। বায়োগ্যাস থেকে দশমিক ৬৯ মেগাওয়াট। আর বায়োমাস থেকে দশমিক ৪ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বর্তমানে গ্রিডে যোগ হচ্ছে ৪২৫ দশমিক ৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌর বিদ্যুতে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি নেই। এছাড়া উৎপাদন খরচও কম। এ কারণেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি এখন বাড়তি মনযোগ পাচ্ছে।
উল্লেখ্য, নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় যুক্ত করা হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে। সে পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে চায় সরকার।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম