লাকসাম-রাউজানের ‘ভোটবিহীন নির্বাচনে’ মাহবুব তালুকদারের ‘প্রশংসা’
১৪ নভেম্বর ২০২১ ১৭:৪৫
ঢাকা: দেশব্যাপী চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিভিন্ন পদে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে সব মহল থেকেই। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও যোগ দিলেন সেই আলোচনায়। কুমিল্লার লাকসাম ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সবগুলো ইউপিতে সব প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কটাক্ষ করেছেন তিনি।
মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘বিদ্রোহী’ বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় এই নির্বাচন ছিল ‘শান্তিপূর্ণ’। এরকম নির্বাচন হলে নির্বাচন কমিশনের কোনো প্রয়োজন থাকবে না বলেও মন্তব্য তার।
রোববার (২৩ নভেম্বর) নির্বাচন কমিশন ভবনে নিজ কার্যালয়ে ‘দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ: আমার কথা’ শিরোনামে লিখিত বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। নির্বাচন এখন প্রকৃতপক্ষে আইসিইউতে এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে রয়েছে— লিখিত বক্তব্যে এ কথাও বলেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়। এই ধাপে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ১৪ ইউনিয়নেও ভোটের তফসিল ছিল। কিন্তু এই ১৯টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে প্রত্যেকেই ছিলেন একক প্রার্থী। ফলে এই দুই উপজেলায় ভোট ছাড়াই সবাই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।
এই দুই উপজেলার ইউপি নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে মাহবুব তালুকদার বলেন, স্থানীয় ক্ষমতাধরদের রোষানল থেকে রক্ষা করতে সাহসী রিটার্নিং অফিসার ও সাহসী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা বা নিরাপত্তা দেওয়ার নজির নেই। সেদিক থেকে বিশ্বে আদর্শ নির্বাচনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। অন্যদিকে রাউজান উপজেলায় ১৪ ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান, ১২৬ জন পুরুষ সদস্য ও ৪২ জন সংরক্ষিত নারী সদস্যের সবাইও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো উপজেলায় চেয়ারম্যান ও সদস্যের ১৮২টি পদে নির্বাচিত হতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়নি।
কিছুটা কটাক্ষ করেই মাহবুব তালুকদার বলেন, নির্বাচনে কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্বাচন ছিল খুবই শান্তিপূর্ণ। সারাদেশে যদি সন্ত্রাসমুক্ত এ ধরনের নির্বাচন করা যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের বদলে একজন সচিবের অধীনে একটি সচিবালয় থাকাই যথেষ্ট।
নির্বাচন আইসিইউতে, গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে
বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে আলোচিত এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ যতই ফুরিয়ে আসছে নির্বাচনব্যবস্থা ও অবস্থা দেখে আমরা ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। আজও রূপকার্থে কিছু কথা বলতে চাই। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে।
কথাগুলোর ব্যাখ্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব গণতন্ত্রকে অন্তিম অবস্থায় নিয়ে গেছে। খেলায় যেমন পক্ষ-বিপক্ষের প্রয়োজন হয়, তেমনি একপাক্ষিক কোনো গণতন্ত্র হয় না। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে আমরা লাইফ সাপোর্ট থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাই। এজন্য দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
দলমত নির্বিশেষে সবার সমঝোতার গুরুত্ব তুলে ধরে মাহবুব তালুকদার বলেন, আমি আবারও পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই— এই সংকট নিরসনে সব দলের সমঝোতা অপরিহার্য। সংবিধানের বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও সুদীর্ঘ ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন প্রণয়ন করা হয়নি। নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কারের জন্য এই আইন প্রণয়ন অবধারিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। এতে নিরপেক্ষভাবে সব রাজনৈতিক দলের স্বার্থ সংরক্ষণ করা আবশ্যক এবং তা সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। একপাক্ষিক আইন করে কোনো লাভ হবে না। একপাক্ষিক আইন কেবল একদলীয় শাসনের পথ উন্মুক্ত করে। বিষয়টির যত তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয়, ততই মঙ্গল। নইলে দেশব্যাপী নৈরাজ্যের আশঙ্কা আছে।
প্রসঙ্গ নির্বাচনি সহিংসতা, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ভূমিকা
লাকসাম-রাউজানে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও এবারের দুই ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে দেশব্যাপী সহিংসতার শিকার হয়েছে বেশকিছু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে মাহবুব তালুকদার বলেন, এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে রক্তাক্ত নির্বাচন বললে অত্যুক্তি হবে না। নির্বাচনের সময় ও তার আগে পরে এ পর্যন্ত ৩৯ জন নিহত হয়েছেন। জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয়— এ বার্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছি।
সারাদেশে অনেক প্রার্থীরই এমন বিনা ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, গত ১১ নভেম্বর ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৮০ জন চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। একে আক্ষরিক অর্থে নির্বাচন বলা যায় না। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেখানে নির্বাচন নেই। ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হয়ে আগের মতো সবার জন্য উন্মুক্ত হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, আমার মতে, পৃথক একটি স্থানীয় নির্বাচন কর্তৃপক্ষ গঠন করে এসব নির্বাচন করা যায়। যে নির্বাচন প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন ঠিক করে না, তার দায় কমিশন কেন নেবে? তবে এই পরিবর্তন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
মাহবুব তালুকদার বলেন, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের বড় সমস্যা হলো রিটার্নিং অফিসারদের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কিংবা স্থানীয় নেতাদের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত মনোভাব অনুধাবন করে চলতে হয়। ফলে তারা হানাহানি, গোলযোগ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো ধামাচাপা দিতে চান। তাদের ধামাধরা না হয়ে উপায় থাকে না। বিভিন্ন নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে আমার এ ধারণা হয়েছে। নির্বাচনে তাদের সাহসী ভূমিকা পালনের কথা বলে লাভ নেই।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
ইউপি নির্বাচন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন কমিশনার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত মাহবাবুব তালুকদার