Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গ্রামে ডায়াবেটিস: তিন দশকে রোগী বেড়েছে ৪ গুণ

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৫ নভেম্বর ২০২১ ১০:১৩

ঢাকা: ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত দেশের গ্রামাঞ্চলে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র দুই শতাংশ। এর তিন দশক পর এখন গ্রামাঞ্চলের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষের শরীরে এই রোগের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সে হিসাবে তিন দশকে গ্রামাঞ্চলে প্রায় চার গুণ বেড়েছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। কেবল ১৮ বছরের বেশি বয়সীই নয়, ছয় দশক ধরেই গ্রামের শিশুদের মধ্যেও ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে গ্রামের অধিবাসীরা এখন শহরের মতো প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। সেইসঙ্গে খাদ্যাভ্যাসেও আসছে পরিবর্তন, যা বাড়াচ্ছে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি। সচেতনতার অভাবে বাংলাদেশে যে হারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে এটি স্বাস্থ্য খাতের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে উঠতে পারে উল্লেখ করে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রোগী শনাক্তের পাশাপাশি সব পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যান্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে আশির দশকে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র দুই শতাংশ।

২০১৮ সালে দেশের সব উপজেলায় স্বাস্থ্য অধিদফতর পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, শহর ও গ্রামের মানুষের মাঝে আক্রান্তের পার্থক্য খুব একটা নেই। শিক্ষিত কিংবা অল্প শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও পাওয়া যায়নি। যাদের মধ্যে ধূমপান, অস্বাভাবিক জীবনযাপন ও শারীরিক পরিশ্রমের হার কম তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার বেশি।

তবে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স তাদের মধ্যে যেখানে শহরে ১৪ শতাংশ নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সেখানে গ্রামে আক্রান্তের হার আট শতাংশ। একইসঙ্গে, এই বয়সসীমায় গ্রামে ১০ শতাংশ পুরুষ ডায়াবেটিসে ভুগলেও শহরে ১৩ শতাংশ পুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আশির দশকেও যেখানে গ্রামাঞ্চলে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র দুই শতাংশ, সেখানে গ্রামে আট শতাংশ নারী ও ১০ শতাংশ পুরুষের আক্রান্তের হার অনেক বেশি। প্রাথমিক পর্যায়েই এসব রোগীদের সেবার আওতায় আনার বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে বলে অভিমত তাদের। একইসঙ্গে, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথাও জানান বিশেষজ্ঞরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডিপার্টমেন্ট অব অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও আসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল অ্যান্ডোক্রাইনোলজিস্ট অ্যান্ড ডায়াবেটোলজিস্ট বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৯৬০-৬২ সালের দিকে ইব্রাহীম স্যার একটা রিসার্চ করেছিলেন ঢাকার অদূরবর্তী একটি গ্রামে। সেই গবেষণায় এক দশমিক ৬২ শতাংশ মানুষের মাঝে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তা আশির দশকে বেড়ে গিয়ে হয় দুই শতাংশ। তবে গ্রামের মানুষের মাঝে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার হার পরবর্তী সময়ে আরও বাড়ে। এই সময়ে শহরে আক্রান্তের হার যে কম ছিল তাও না। গ্রামের আক্রান্তের সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ এ সময়ে শহরেও আক্রান্ত হয়।’

তিনি বলেন, ‘গ্রামে তিন দশকে প্রায় তিন থেকে চার গুণ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী বেড়েছে। এটা কিন্তু গাণিতিক হারে বাড়ে না। বলা যেতে পারে এটা আনুপাতিক হারে বাড়ে। এখন যদি প্রতি বছরে দুই, চার, ছয়, আট শতাংশ হারে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে গ্রামে তবে ভবিষ্যতে এটা একটা বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। এটা কিন্তু একটা অ্যালার্মিং সাইন আমাদের মতন ডেভেলপিং কান্ট্রিগুলোর জন্য। কারণ ডেভেলপড কান্ট্রিতে কিন্তু এটা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা থাকায় ভালো ফলাফল পেয়েছে। এসব দেশে যদি ১০ শতাংশ হারে রোগী বাড়ে তবে আমাদের ক্ষেত্রে সেটা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন কিন্তু গ্রামে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেখানে লেগেছে আধুনিক জীবনের ছোঁয়া। খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন এসেছে অনেক। এখন গ্রামেও কিন্তু চলাচলের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনেক যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে মানুষের কায়িক পরিশ্রমের হার কমেছে একদিকে। আর তাই উদ্বেগজনক হারে সেখানেও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু আক্রান্তদের অর্ধেকেরই কোনো লক্ষণ না থাকায় ঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন না। আবার অনেকে মানসিকভাবে ভয় পেয়ে চিকিৎসার আওতায় আসছেন না। এগুলো উদ্বেগজনক বিষয়।’

এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ডায়াবেটিস রোগীদের জাতীয়ভাবে কোনো পরিসংখ্যান এখনো লিপিবদ্ধ হয়নি। ভারতে জাতীয় পরিসংখ্যান অনুসারে এর হার হচ্ছে ১১ দশমিক ৯। বাংলাদেশে শনাক্ত করা রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লাখ। বাকি প্রায় ৮৪ লাখ রোগী এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। প্রায় এক কোটি মানুষ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে। তাদের শনাক্ত করে সঠিক স্বাস্থ্যবিধির উপদেশের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখ লোকের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।’

ডা. ফরিদ বলেন, ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম—এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। গ্রামাঞ্চলে পূর্বের তুলনায় কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। আর ডায়াবেটিস বাড়ার কারণ শরীরের ওজন অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া। ডায়াবেটিস রোগীর সুগার, রক্তচাপ ও রক্তের চর্বির নিয়ন্ত্রণ একসঙ্গে খুব কমই থাকে। খোদ আমেরিকায় এ হার ২৬। বাংলাদেশের অবস্থা আরও শোচনীয়—৪ শতাংশের নিচে। এ কারণে ডায়াবেটিস রোগীরা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে বেশি মারা যায়। ডায়াবেটিস রোগীর অন্ধ হওয়া, কিডনি নষ্ট হওয়ার মাত্রা অনেক বেশি। আমাদের দেশে সিসিইউ, আইসিইউ, ডায়ালাইসিস এবং করোনায় আক্রান্ত রোগীর প্রায় অর্ধেক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।’

তিনি বলেন, ‘এ অবস্থার উন্নতির জন্য সচেতনতা, সামগ্রিক সম্পৃক্ততা ও জাতীয় মাস্টারপ্ল্যান ও অ্যাকশন প্ল্যান প্রয়োজন। আমাদের সবার এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সেবার দ্বার সহজ ও সহজলভ্য করতে হবে। সেবার সব উপকরণ ক্রয়-সক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারের ইউনিয়ন সাবসেন্টার থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে অবকাঠামো ও সুযোগ অনুসারে ডায়াবেটিস চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এনসিডি কর্নারের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এটি খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমাদের জেলা হাসপাতালে ডিইএম সেন্টারের মাধ্যমে ডায়াবেটিস ও হরমোনের রোগীর সেবা বাড়ানো সম্ভব। আমাদের অ্যান্ডোক্রাইন ডিপ্লোমা করা ডাক্তারদের ডিইএম সেন্টারে কনসালট্যান্ট করে এ সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। এমডি করা প্রায় ১০০ ডাক্তার বিভিন্ন হাসপাতালে সেবা দিচ্ছেন। পর্যায়ক্রমে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডিপার্টমেন্ট খুলে ও দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ডায়াবেটিস সেবার দ্বার ও মান উন্নত করা যেতে পারে।’

যদি এগুলো নিশ্চিত করা যায় ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত শনাক্ত করা যায় তবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।

গ্রামে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের প্রধান ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ সারাবাংলাকে বলেন, শহরের পাশাপাশি গ্রামেও বিগত সময়গুলোতে মানুষের জীবনধারায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শহরের মানুষের সঙ্গে তাদের মাঝেও কায়িক পরিশ্রমের হার প্রতিনিয়ত কমছে। আগে গ্রামে প্যাডেলের মাধ্যমে রিকশা-ভ্যান চললেও সেগুলো এখন ব্যাটারিচালিত অটো হয়েছে। এতে উদ্বেগজনকভাবে গ্রামেও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে ডায়াবেটিস বাড়ছে। একইসঙ্গে দেখা যায় খাদ্যাভাসেও এসেছে পরিবর্তন। জাঙ্ক ফুড খাওয়ার মাত্রাও বেড়েছে। আর সব মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। তাই এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ করে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে প্রাথমিক অবস্থাতেই ডায়াবেটিস রোগীদের স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে পারলে অন্তত আসল পরিস্থিতিটা বোঝা যেতে পারে।’

জানতে চাইলে ডায়াবেটিক সমিতির সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চের সমন্বয়ক ডা. বিশ্বজিৎ ভৌমিক বলেন, দেশে ৪২৬টি উপজেলায় এক লাখ মানুষের ওপর একটি জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও জানেন না।

তিনি বলেন, যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের ৪০ শতাংশের ওজন স্বাভাবিক। কায়িক পরিশ্রম কম হওয়া, অতিরিক্ত ওজন, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, কম হাঁটা-চলা ও গ্রামে যানবাহন ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় রোগী বাড়ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আমাদের দেশে ডায়াবেটিসের রোগীর হার বাড়ছে। শহর অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ সচেতনতার অভাব। আমাদের খাদ্যাভাসে ভাত কিংবা শর্করা নির্ভর খাওয়ার আধিক্য রয়েছে। এছাড়াও আজকাল গ্রামেও কিন্তু ফার্স্ট ফুড কিংবা জাঙ্ক ফুডের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস ডায়াবেটিসের হার বাড়াচ্ছে গ্রামেও।’

তিনি বলেন, ‘আজকাল শহুরে জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামাঞ্চলেও মানুষের জীবনাচরণ পাল্টাচ্ছে। আগে আমরা দেখতাম গ্রামের মানুষ নানাভাবে শারীরিক চর্চার মধ্যে থাকতো। কিন্তু শহরের মতো করেই গ্রাম অঞ্চলের মানুষেরাও আজকাল শারীরিক শ্রমের চেয়ে বিভিন্ন ডিভাইসের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। আজকাল গ্রামের মাঠেও কিন্তু সেভাবে খেলাধূলা হয় না; যেমনটা একসময় দেখা যেত। একদিকে মাঠে খেলাধূলার হার কমছে, আর অন্যদিকে বাড়ছে নানা রকম ডিভাইসের প্রতি আসক্তি। ফলে কমে যাচ্ছে শরীর চর্চার অভ্যাস। আর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে মানুষকে আগে রোগ নির্ণয়ের জন্য স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আসতে হবে। ডায়াবেটিস সম্পর্কে স্বাস্থ্যশিক্ষা সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ে ডায়াবেটিস বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’ মানুষ সচেতন হলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।’

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর ডা. বেদৌরা জাবীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের গ্রামের মানুষজন এখনো শহরের মতো লাইফ স্টাইল পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। কিন্তু সেখানেও বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। কারণ সেখানেও বাড়ছে ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড খাওয়ার প্রবণতা। তবে সেখানে এখনো শহর অঞ্চলের মতো বৃদ্ধি পায়নি।’

তিনি বলেন, ‘শহরে দেখা যায় উচ্চবিত্তদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার বাড়ছে বেশকিছু কারণে। প্রথমত হচ্ছে- টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেশি হচ্ছে শহর এলাকায়। যাদের ওজন বেশি তাদের মাঝে এই প্রবণতা বেশি পাওয়া যায়। শহর অঞ্চলে দেখা যায় বাচ্চাদের খাদ্যাভাস অতটা স্বাস্থ্য সম্মত না। তাদের অধিকাংশই দেখা যাচ্ছে, ফাস্ট ফুড ও জাঙ্ক ফুডের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডেও দেখা যায় তারা এগুলো খাচ্ছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের বাচ্চাদের ঘরেও দেখা যাবে তাদের বাবা অথবা মা’র মাঝে কেউ না কেউ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের আক্রান্ত। যদি পরিবারের রক্তের সম্পর্কের মাঝে কারও টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকে তবে দেখা যায় বাচ্চাদের মাঝেও সেটা ছড়িয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে যদি বাচ্চার ওজন বেশি থাকে ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসে অভ্যস্থ হওয়ার পাশাপাশি খেলাধূলার পরিমাণ তথা শারীরিক চর্চার ঘাটতি থাকে তবে ডায়াবেটিস সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’

গ্রামাঞ্চলের যদি এভাবে আনুপাতিকভাবে শহুরে জীবনের প্রভাব বাড়তে থাকে তবে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ার সম্ভাবনা বেশি বলে জানান ডা. বেদৌরা জাবীন।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ‘ডায়াবেটিস হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান অন্যতম অসংক্রামক ব্যাধি। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। শহর অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামেও এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর্যাপ্ত শরীর চর্চা এবং ফাস্টফুড নির্ভর খাদ্যাভ্যাসসহ অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস এবং জিনগত কারণসহ অনেকগুলো কারণ ডায়াবেটিস রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি আমরা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করি তাহলে আমরা ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারি। ২৫ শতাংশ রোগী স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ২০১৮ সালের স্টেপ-২ সার্ভেতে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১১ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এছাড়াও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার বাড়ছে। আবার দেখা যায়, তিন শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে ডায়াবেটিসের কারণে। এসব কারণে শুধু প্রতিরোধই নয় বরং ডায়াবেটিস বিষয়ে সবাইকে সচেতন করে তোলার কাজও শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ডায়াবেটিস রোগী বর্তমানে যে হারে বাড়ছে তা অবশ্যই অ্যালার্মিং। আমাদের এখানে খ্যাদ্যাভাসের অবস্থা খুবই বাজে। আমাদের দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা যায়, ডায়াবেটিস অনেকটা এপিডেমিকসের মতো চলছে। শহরে মানুষের আসলে তেমনভাবে শারীরিক চর্চার কোনো স্থান নেই। কারণ আমাদের শহরগুলোকে আসলে সম্পূর্ণভাবে স্বাস্থ্যকর বলে বলা যায় না। আজকাল গ্রামও হয়ে যাচ্ছে শহর। আর তাই সেখানের মানুষেরাও যারা আগে নানারকম শারীরিক চর্চার মধ্যে ছিল তারাও অলস হয়ে পড়ছে শহরের মতো। সেখানেও খাদ্যাভাস পাল্টাচ্ছে শহরের মতো।’

ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘আমাদের বাচ্চাদের বর্তমান পরিস্থিতি যদি বিবেচনা করা হয় তবে দেখা যাবে, তারা জাঙ্ক ফুডের দিকে ঝুঁকছে। সেগুলো কিন্তু স্বাস্থ্যকর না। তাছাড়া আসলে কোন খাদ্যটা স্বাস্থ্যসম্মত সে বিষয়েও আজকাল কিছুটা জ্ঞানের অভাব প্রায় সব জায়গাতেই রয়েছে। এগুলো অনেকে বুঝেও না। আর এসব কিছুর জন্য আমাদের কিছু সচেতনতামূলক কর্মসূচি বিস্তৃত আকারে করার পরিকল্পনা আছে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত।’

তিনি বলেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই চলছে। এগুলো আগামীতে আরও জোরদার করা হবে। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগী শনাক্তে স্ক্রিনিং বাড়ানো হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের মাঝে ডায়াবেটিসের স্ক্রিনিং বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে। এরপরে কমিউনিটি ক্লিনিকের নিয়ে এসে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সুবিধার আওতায় আনা হবে।

ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৫০ ভাগেরই কোনো লক্ষণ থাকে না। আর তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে চল্লিশোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বর্তমানে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্র আছে। এছাড়াও ডায়াবেটিসসহ সব অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনসিডিসি কর্নার স্থাপনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১০০টি হাসপাতালে চালু হয়েছে। এ ছাড়া আট মেডিকেল কলেজে অ্যান্ডোক্রানোলজি বিভাগ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বারডেম, ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক (এনএইচএন) ও বিআইএইচএসের ৩২টি কেন্দ্র, ৬১টি অধিভুক্ত সমিতি ও ২১টি সাব এফিলিয়েটেড অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে রাজধানীসহ সারা দেশে ডায়াবেটিস-সেবা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ‘ডিসটেন্স লার্নিং প্রজেক্ট’-এর মাধ্যমে ইতিমধ্যে ৩১তম ব্যাচ পর্যন্ত প্রায় ১৮,০০০ জেনারেল প্র্যাকটিশনারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডায়াবেটিস সেবা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে বাডাস।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে অসংক্রামক রোগের কারণে অন্তত ৬১ ভাগ মানুষ কোনো না কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। এর মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। রোগটি নীরবে শরীরে চলে আসে। দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের পাশাপাশি শহরের মানুষজনও অনেকেই স্বাস্থ্য সচেতনতা বা ডায়াবেটিস নিয়ে তেমন একটা সচেতন নয়।

তিনি বলেন, দেশের মাত্র ১২ ভাগ মানুষের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু অনেকেই টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে যান না। ফলে শহর বা গ্রামের প্রতিটি হাসপাতাল থেকেই রোগটির প্রায় সব ওষুধ ও চিকিৎসা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। ডায়াবেটিসের ব্যয়বহুল চিকিৎসাসামগ্রী ইনসুলিনও বিনামূল্যে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

সারাবাংলা/এসবি/একেএম

গ্রামে ডায়াবেটিস টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

এখনো সালমানকে মিস করেন মৌসুমী
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৩

সম্পর্কিত খবর