Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অন্ধ চোখে কাজল কেন— পাসপোর্ট অফিসে হেনস্থার শিকার তানিয়া

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৫ নভেম্বর ২০২১ ২০:৪১

ঢাকা: রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসে ই-পাসপোর্টের জন্য ছবি তুলতে গিয়ে একটি বেসরকারি সামাজিক সেবা উদ্যোগের কর্মকর্তা তানিয়া নূর হেনস্থার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার একটি চোখ দৃষ্টিহীন হলেও দেখতে স্বাভাবিক চোখের মতো। সেটি নিয়েই অসংবেদনশীল প্রশ্ন তুলেছেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা। এমনকি দৃষ্টিহীন চোখে কাজল দেওয়া নিয়েও তারা বিদ্রুপ করেছেন তানিয়াকে!

ই-পাসপোর্টের আবেদনের পর গত বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) নির্ধারিত সময়ে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে ছবি, চোখের মনি স্ক্যানিং ও আঙুলের ছাপ দিতে তানিয়া নূরের সঙ্গে এ ঘটনা ঘটে। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের এক পোস্টে ঘটনাটি তুলে ধরেছেন তিনি। সারাবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেবেন। অন্যদিকে পাসপোর্ট অফিস বলছে, ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা তানিয়া নূর। বাবা এ কে এম নুরুননবী। মা সামসাদ নবী। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তানিয়া ছোট। ছোটবেলা থেকেই তার একটি চোখ দৃষ্টিহীন। তবে সে কারণে কখনো পিছিয়ে পড়তে হয়নি তাকে। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০১ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধাতালিকায় তৃতীয় হয়েছিলেন। এরপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে। এখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে ফের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী তিনি। পাশাপাশি কাজ করছেন আই সোশ্যাল নামে একটি বেসরকারি সামাজিক সেবা উদ্যোগের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে।

বিজ্ঞাপন

ফেসবুক পোস্টে তানিয়া জানিয়েছেন, একটি চোখ দৃষ্টিহীন হলেও এর জন্য কখনোই কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়নি তাকে। বরং শিক্ষা ও পেশাজীবনে বরাবরই মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তানিয়া লিখেছেন, আমি যে নিজেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাবছি না, সেটিই বড় অপরাধ। অথচ আমি ঢাকা বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় তৃতীয় হয়েছি কোনো বাড়তি সুযোগ না পেয়েই। আমি লিখেছি, দুইটা যন্ত্র বাজাতে পেরেছি, সংগীতের সার্টিফিকেট কোর্স শেষ করেছি, সাংবাদিকতা করেছি। আজ পর্যন্ত অন্ধ হিসেবে কোনো সুবিধা নিইনি বা নিজের প্রতিবন্ধকতাকে পুঁজি করে কোনো কাজ ফাঁকি দেইনি।

এখন পর্যন্ত দৃষ্টিহীন এই চোখ নিয়ে কোথাও কোনো হেনস্থা হতে না হলেও এবারে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তানিয়া। সেখানে তার চোখ নিয়ে রীতিমতো আপত্তিকর সব প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাকে। তানিয়া লিখেছেন, আজ বাংলাদেশ সরকারের নাগরিক হিসেবে ই-পাসপোর্ট করতে গিয়ে প্রথম জানতে পারলাম যে আমি অন্ধ— এর জন্য সার্টিফিকেট লাগবে। ঢাক পিটিয়ে প্রচার করতে হবে আমি অন্ধ!

এরপর পাসপোর্ট অফিসের অন্তত চার জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে যে আপত্তিকর প্রশ্নগুলো শুনেছেন, সেগুলো হলো— আপনি অন্ধ এটার সার্টিফিকেট কই; আপনি যে দেখেন না, তো চোখ এমন স্বাভাবিক কেন? আর আপনি গোপন করলেন কেন; আপা আপনি চোখে কাজল দিয়ে আসছেন বলেই স্ক্যান করা যায় না, অন্ধ চোখ নরমাল দেখায় কেন; আপনি অন্ধ তার প্রমাণ কী? আপনার এটা কি নকল চোখ?

দৃষ্টিহীন চোখে কাজল পরা নিয়ে রীতিমতো বিদ্রুপের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তানিয়া। আক্ষেপ নিয়ে তিনি লিখেছেন, জীবনের এত লম্বা যাত্রায় এক চোখ দিয়ে দেখে কোনো কাজে কখনো কম কিছু পেরেছি বলে মনে হয়নি যা দুই চোখওয়ালা মানুষ করছে, করেছে। আর নিজের বিস্মৃতপ্রায় অন্ধত্ব নিয়ে সবসময় বলাটাও অপ্রাসঙ্গিক আর দুর্বলতা বলে আমি মনে করি। আজ বাংলাদেশ সরকারের নাগরিক হিসেবে ই-পাসপোর্ট করতে গিয়ে প্রথম জানতে পারলাম, আমি যে অন্ধ এটার সার্টিফিকেট লাগে! ঢাক পিটিয়ে প্রচার করতে হবে ভাইসব আমি অন্ধ।

তিনি আরও লিখেছেন, আমাকে ডাক্তারের কাছ থেকে অন্ধত্বের প্রমাণ সংগ্রহ করে আনতে হয়েছে শেষমেষ। আর জীবনে এই প্রথম এই বিষয়টি নিয়ে পাবলিকলি চোখে জল গড়িয়েছে।… আমি এই অন্ধ চোখে অনন্ত আকাশ আরও বড় দেখি। আর সবুজ পাসপোর্টটাকে অচেনা লাগে… আমরা নাকি ডিজ্যাবিলিটি ইনক্লুশন নিয়ে কী কী সব বলতে থাকি! যে দেশে প্রশাসনিক পর্যায়ে সামান্য মানবিকতার-সভ্যতার আভাস নেই, সেই সিস্টেম নাকি আমার ট্যাক্সের টাকায় চলে?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার (১৫ নভেম্বর) বিকেলে তানিয়া নূর সারাবাংলাকে বলেন, আমার যা বলার সেটি তো ফেসবুকে লিখেইছি। আমার পরিবার ঘটনাটি জেনেছে। আমার পরিবার পাসপোর্ট অধিদফতরের বিরুদ্ধে মামলা করতে চায়।

তানিয়া নূরের পরিবার চাইলে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন— এমনটি জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীনও। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, কারও কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বৈষম্য করা অসাংবিধানিক ও বেআইনি। এটি করার সুযোগ নেই। ইচ্ছা করলে ভুক্তভোগী আইনি প্রতিকার চেয়ে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন।

তানিয়া নূরের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, সেবাপ্রত্যাশী ওই নারীর ফেসবুক স্ট্যাটাসটি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্তের ব্যবস্থা করছি। অভিযোগকারী সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে দুই হাতের ১০ আঙুলের ছাপ, চোখের মনির স্ক্যান এবং মুখমণ্ডলের প্রতিরূপ অক্ষত থাকতে হয় বলে জানাচ্ছেন তিনি। পাসপোর্টের ডিজি বলেন, ই-পাসপোর্ট পেতে হলে দুই হাতের চাপ এবং চোখের মণি ও মুখমণ্ডলের প্রতিরূপ অক্ষত থাকা আবশ্যক। ই-পাসপোর্টে এসব তথ্য না থাকলে পাসপোর্ট বাহক ঝামেলায় পড়বেন। সেক্ষেত্রে সার্ভারে এসবের চিকিৎসক সনদ থাকলে বাহক হয়রানিমুক্ত থাকবেন। সে কারণেই আমরা মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসকের সনদ সার্ভারে সংরক্ষণ করছি।

ই-পাসপোর্টের আবেদন ফরমে এ ধরনের প্রতিবন্ধিতার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সনদ বহনের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে কি না— জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী বলেন, পাসপোর্ট ফরমটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়। সেখানে এ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের উল্লেখ নেই। বিদ্যমান ফরমে আরও কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই সমস্যাগুলো যেন না থাকে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

তানিয়া নূর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দৃষ্টিহীন চোখ পাসপোর্ট অফিস হেনস্থার শিকার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর