কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর প্রকল্প গতিহীন
১৭ নভেম্বর ২০২১ ০৮:১৩
ঢাকা: শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্য নিয়ে শ্রমিকদের কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে ২০১৮ সালে চার বছর মেয়াদে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ‘স্কিলস-২১ ইমপাওয়ারিং সিটিজেনস ফর ইনক্লুসিভ অ্যান্ড সাসটেইনেবল গ্রোথ’ প্রকল্পটি। ১৮৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পটিতে এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে সাড়ে তিন বছর। তবে এর মধ্যে প্রকল্পটিতে বরাদ্দের মাত্র ৮৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা খরচ করা সম্ভব হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতির হারও খুবই কম। এ অবস্থায় প্রকল্পটির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে বাড়তি খরচও ধরা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত এই প্রস্তাব অনুমোদন পেলেও আট মাসে প্রকল্পের বাকি টাকা খরচসহ বাস্তব অগ্রগতি অর্জন করা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের আওতায় কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে কমিশনে। প্রস্তাবটি নিয়ে গত ৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম।
সূত্র জানায়, ‘স্কিলস-২১ এমপাওয়ারিং সিটিজেনস ফর ইনক্লুসিভ অ্যান্ড সাসটেইনেবল গ্রোথ’ প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৮৭ কোটি টাকা। মূল প্রকল্পটিতে সরকারের তহবিল থেকে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং উন্নয়ন সহযোগীর অনুদান থেকে ১৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে না পারায় এবারে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ এবং ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা বাড়তি খরচ ধরা হয়েছে প্রকল্পটির জন্য।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য কী ছিল
প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক (বিএনকিউএফ) প্রণয়ন ও দুইটি টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং (টিভিইটি) প্রতিষ্ঠানকে সেন্টার ফর স্কিলস এক্সিলেন্স (সিএসই) হিসেবে উন্নয়ন করা হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থার মান উন্নয়ন করা হবে। এছাড়া সাতটি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে মডেল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থায় সমতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণের উন্নয়ন করার সুযোগ তৈরি হবে। সেক্টর ওয়াইড ইন্ট্রিগ্রেটেড ফ্রেমওয়ার্ক ফর টিভিইটি’র (এসডব্লিউআইএফটি) মাধ্যমে দেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থায় সুশাসন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন উপযোগী সমন্বিত পদ্ধতি প্রবর্তন করাও ছিল প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য।
প্রকল্পের ধীরগতি ও সংশোধনের কারণ
কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর জানিয়েছে, দেরিতে শুরু হওয়া এবং কোভিড-১৯ মহামারিজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এ জন্য প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবশিষ্ট কার্যক্রম শেষ করতে উন্নয়ন সহযোগী ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অপারেশনাল ডিউরেশন অব ফিন্যানসিং এগ্রিমেন্টের মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ডেলিগেশনকে (ইইউডি) প্রকল্পটির মেয়াদ ১৮ মাস বাড়াতে অনুরোধ করে। পরে ইইউডি অপারেশনাল ইমপ্লিমেন্টেশন ফেজ ৪৮ মাস থেকে ১৮ মাস বাড়িয়ে ৬৬ মাস নির্ধারণ করে।
এ অবস্থায় করোনাকালীন যেসব শ্রমিক বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন, তাদের দক্ষতা বাড়ানো ও সনদায়নের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরও অতিরিক্ত ৩০ লাখ ইউরো সমপরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা এই প্রকল্পে অনুদান হিসেবে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই প্রকল্পের কিছু অংশের প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে প্রশিক্ষণের জন্য নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মেয়াদও ছয় মাস বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদন প্রক্রিয়াকরণের জন্য পাঠানো হয়েছে।
সংশোধনী প্রস্তাবে যা বলা হয়েছে
প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শ্রমবাজারের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশগতভাবে সচেতন, সমন্বিত, চাহিদা ভিত্তিক এবং আন্তঃসম্পর্কীয় দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে। এছাড়া উন্নততর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থার গুণগত মান বাড়ানো, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্পর্কিত মডেল ইনস্টিটিউটগুলোর মাধ্যমে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার ও সমতা আনা এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ উন্নয়ন ব্যবস্থার পরিচালন পদ্ধতির উন্নতির মাধ্যমে একটি সক্রিয় পরিবেশ তৈরি করার জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল।
পরিকল্পনা কমিশনের মতামত
প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে এরই মধ্যে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভার কার্যপত্রে পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বলা হয়েছে— ২০১৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশনের কাছ থেকে ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রকল্প সংশোধন না করে কেন চলতি বছরে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে— এ বিষয়টি কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের প্রতিনিধির কাছে জানতে চাওয়া হয়।
প্রকল্পের মিডটার্ম ইভালুয়েশন (এমটিই) অনুযায়ী আরটিএপিপিতে টিএপিপি হতে লোকাল ট্রেনিং খাতের আওতায় ইয়ুথ ট্রেনিং টার্গেট ১৭ হাজার ৫০০ জন থেকে কমিয়ে ১৩ হাজার ২৫০ জন করা হয়েছে। টিচারর্স অ্যান্ড অ্যাসেসরস ট্রেনিং ১৫০০ জন থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার ২৪০ জন করা হয়েছে। এ বিষয় সভায় আলোচনার প্রয়োজন বলেও মত দেওয়া হয়।
এছাড়া অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের ব্যয় বাড়ানো হলেও অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের প্রাক্কলিত ব্যয় কমানো হয়েছে। এছাড়া এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত কতটি বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বা সফর হয়েছে, তার তথ্য সভায় আলোচনা করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। যে সাতটি মডেল ইনস্টিটিউট ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ও মেরামত প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর তালিকা আরটিএপিপিতে সংযুক্ত আছে কি না, সেটিও সভাকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
প্রকল্পটি নিয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাবেক সচিব ও বর্তমানে পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, যেকোনো প্রকল্পই সময়মতো বাস্তবায়ন না হলে ব্যয় বেড়ে যায়। এতে একদিকে অর্থের যেমন অপচয় হয়, অন্যদিকে যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়, সেটিও সময়মতো পূরণ হয় না। অর্থাৎ জনগণ সুবিধাবঞ্চিত হয়ে থাকে। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও এটি হয়েছে। এ ধরনের নজির কারও কাম্য নয়।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর
কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ কারিগরি দক্ষতা কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর