কী হবে মেয়র জাহাঙ্গীরের?
১৯ নভেম্বর ২০২১ ১১:১৫
গাজীপুর: গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ উঠেছিল গত সেপ্টেম্বরে। ওই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের নিয়ে জাহাঙ্গীর অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে জাহাঙ্গীর সাংগঠনিক ব্যবস্থার মুখে পড়তে যাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র থেকে।
জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রও বলছে, গাজীপুর সিটি মেয়রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে আওয়ামী লীগ। তারা জানান, ‘বিতর্কিত মন্তব্য’ করায় দল থেকে বহিষ্কারের মতো সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শাস্তিও পেতে পারেন মেয়র জাহাঙ্গীর। একইসঙ্গে তাকে মেয়র পদ থেকে সরাতে আইনি পথও খুঁজছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করেছেন। তার এমন বক্তব্য দলীয় ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরিপন্থি। এ কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাহাঙ্গীর আলমের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার ও মেয়র পদ থেকে অপসারণের দাবি জানান গাজীপুর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। টানা টানা কয়েকদিন থেমে থেমে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলনও করেন।
ঘটনাটির খবর কেন্দ্র পর্যন্ত গড়ালে সেখানেও নড়েচড়ে বসেন কেন্দ্রীয় নেতারা। গত ৩ অক্টোবর তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাকে সে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়— সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত আপনার বক্তব্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে, যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল। এটি সংগঠনের গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জানা গেছে, মেয়র সে নোটিশের জবাব দিলে ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে সেটি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘তার (মেয়র জাহাঙ্গীর) শোকজের জবাব নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম। জবাব আমাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। অনেকটা দায়সারা মনে হয়েছে। সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। একইসঙ্গে মেয়র পদটি নিয়েও ভাবা হচ্ছে।’
নোটিশের জবাবে মেয়র কী লিখেছেন— জানতে চাইলে ওই বোর্ড সদস্য বলেন, ‘জাহাঙ্গীর চিঠিতে দাবি করেছেন, তার বক্তব্যগুলো জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সবশেষে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন।’
স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, দলের আদর্শের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকেরাও একমত। তবে ঠিক কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে, এ বিষয়টি কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কারের দাবি রয়েছে। আগের মতো তারা সড়কে আন্দোলন না করলেও তাদের দাবি থেকে এখনো সরে আসেননি। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররাও জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিও রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মেয়রের ‘কটূক্তি’ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে গাজীপুর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে। এ ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার দাবি করে তার ছবির ওপর ‘ক্রস চিহ্ন’ দিয়ে পোস্টার ছাপিয়েও সেগুলো বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় দেয়ালে দেয়ালে লাগানো হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আগের অনেক অভিযোগও রয়েছে। সেগুলো নিয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামেও আলোচনা হয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। কিন্তু এবারে তিনি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মন্তব্য করে সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন। এরপর আর তাকে ছাড় দেওয়া উচিত হবে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুল্লাহ আল মামুন মন্ডল বলেন, ‘মেয়র জাহাঙ্গীরের কথাগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর প্রভাব ফেলেছে। তার এমন কটূক্তির কারণে সাধারণ জনগণের মনেও অনেক ক্ষোভ জন্মেছে। গাজীপুরের ৯০ শতাংশ নেতাকর্মী এখন চায়, মেয়র জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করা হোক।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন সবুজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে যেই সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটিই যৌক্তিক। প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সিদ্ধান্তের বাইরে এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’
মেয়রের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে— এমন প্রশ্ন নিয়ে কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কেউ মন্তব্য করতে চাননি। তবে কয়েকজন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতোই বলছেন, এ বিষয়ে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। আর সেই সিদ্ধান্ত সঠিক হবে বলেই মনে করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে দলের একাধিক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, জাহাঙ্গীরকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার সহজ হলেও মেয়রের দায়িত্ব থেকে অপসারণে জটিলতা রয়েছে। দলীয় সভাপতি বা কার্যনির্বাহী সংসদ যেকোনো সময় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করতে পারে। কিন্তু মেয়র হিসেবে তিনি শপথ নিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ফলে তাকে মেয়র পদ থেকে অপসারণ করতে হলে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের মাধ্যমেই করতে হবে।
এদিকে, আজ শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বসছে আওয়ামী লীগ। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে এই সভায় ৮১ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটির ৪৯ সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই সভা থেকেই মেয়র জাহাঙ্গীর ইস্যুতে দলের চূড়ান্ত আসবে বলেই জানিয়েছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।
সারাবাংলা/এমও/টিআর
আওয়ামী লীগ কটূক্তির অভিযোগ গাজীপুর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক মেয়র জাহাঙ্গীর