Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি পরিবহন শ্রমিকরা, দ্বন্দ্বের শেষ কোথায়

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৯ নভেম্বর ২০২১ ১৬:৩৯

রামপুরা এলাকায় রাইদা পরিবহনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের বচসা হয় বুধবার

ঢাকা: ভাড়া নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। দিন দিন এই দ্বন্দ্ব চরমে উঠছে। বাস ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জের ধরে শিক্ষার্থীদের হেনস্থা থেকে শুরু করে মারধরের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই পরিবহন শ্রমিকরাও বাস বন্ধ করে রাখছে। সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, এ পরিস্থিতিতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের।

বিজ্ঞাপন

এ মাসের শুরুতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে সারাদেশে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই ধর্মঘট পালন করতে থাকেন পরিবহন মালিকরা। অঘোষিত এই ধর্মঘটে তিন দিন কেবল ঢাকার মধ্যে নয়, দূরপাল্লার সব বাসও বন্ধ ছিল। তৃতীয় দিনে গিয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সব ধরনের বাসের ভাড়া ২৬ শতাংশেরও বেশি বাড়ানো হলে ধর্মঘট তুলে নেন বাস মালিকরা। তবে তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। কেননা নতুন ভাড়া নিয়েও যাত্রীদের সঙ্গে বচসা নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের দ্বন্দ্বই বেশি ঘটছে।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীসহ সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, বাড়তি ভাড়ার নতুন যে চার্ট সরকার দিয়েছে, তার চেয়েও বেশি ভাড়া আদায় করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। অনেক রুটে আগে থেকেই ভাড়া নেওয়া হতো বেশি। বাড়ানোর পর তাদের আগের ভাড়া আর সরকার নির্ধারিত নতুন ভাড়া সমতায় এসেছে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকরা এখন ভাড়া নিচ্ছে আরও বেশি। আগে যে রুটে ১০ টাকা ভাড়া নেওয়া হতো, ২৬ শতাংশ বাড়লে সেখানে নতুন ভাড়া হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ১৩ টাকা। সেখানে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কোনো পরিবহনে ২০ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। ২৫ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৪০ টাকা। ন্যূনতম ভাড়ার দূরত্বে বাসে ৮ টাকা ও মিনিবাসে ১০ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও এক্ষেত্রে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা পর্যন্ত।

সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

সরকার নতুন ভাড়া নির্ধারণের পরদিন থেকেই ভাড়া নিয়ে যাত্রী-পরিবহন শ্রমিক দ্বন্দ্ব লেগেই রয়েছে। এর সঙ্গে সিটিং, গেটলক ও ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়েও বচসা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সিটিং, গেটলক ও ওয়েবিল বাতিলের ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি সেটি। আর শিক্ষার্থীরা ‘হাফ ভাড়া’ দিতে গেলে তা নিয়ে রীতিমতো হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে।

গত ১৫ নভেম্বর উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে জুরাইন রুটে চলাচলকারী রাইদা পরিবহনের বাসে এক শিক্ষার্থী হাফ ভাড়া দিতে গেলে কন্ডাক্টরের রোষানলের শিকার হন। ওই শিক্ষার্থীকে রামপুরা পাওয়ার আগেই জোর করে নামিয়ে দেওয়া হয়। পরে ওই শিক্ষার্থী রামপুরা এলাকায় অন্যান্য সহপাঠীদের খবর দিলে শিক্ষার্থীরা অন্তত ৫০টি বাস আটকে রাখে। ওই সব বাসে থাকা যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বাড্ডা-মালিবাগ সড়কে ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রীদের। পরে পুলিশ, শিক্ষার্থী ও বাস মালিক পক্ষের বৈঠকের পর বিষয়টি সমাধান হয় এবং বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়।

পরদিন বুধবার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বুধবার বিকেলে বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে একজন নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন হেলপার। বাসটি সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের সামনে পৌঁছালে শিক্ষার্থীরা সেটি ভাঙচুর করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়। ঘটনার জেরে কয়েকশ শিক্ষার্থী সদরঘাট, লক্ষ্মীবাজার ও রায়সাহেব বাজার মোড় অবরোধ করে রাখেন।

‘হাফ পাস’ নিয়ে পরিবহন শ্রমিক-শিক্ষার্থী কথা কাটাকাটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে

আন্দোলনে অংশ নেওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম তায়েব সারাবাংলাকে বলেন, হাফ পাস অনুযায়ী ভাড়া দিতে চাইলে হেলপার খারাপ ব্যবহার করেন। এমনকি ঘাড় ধরে নামিয়ে দিতে চান। সেই খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে ওই বাসটিকে আটকে বিচার চেয়ে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। আমাদের দাবি, খারাপ আচারণ করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের ভাড়া নিতে হবে। তা না হলে এই আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়বে।

এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) হাফ পাস চালু ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাসের চালক ও সহকারীদের অসদাচরণের প্রতিবাদে নিউ মার্কেটের সামনের সড়ক প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় সড়কের উভয় পাশে যানচলাচল বন্ধ থাকে। পরে পুলিশ দুই পক্ষের সঙ্গে বসে যানচলাচল স্বাভাবিক করে। শিক্ষার্থীরা বলেন, শনিবারের মধ্যে তাদের দাবি পূরণ না হলে লাগাতার আন্দোলনে যাবেন তারা।

এর মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে ফের পরিবহন শ্রমিকদের হাতে শিক্ষার্থী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। সরকারি তিতুমীর কলেজের চার শিক্ষার্থী হাফ ভাড়া দিতে চাইলে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে চালক ও সহকারীসহ অন্যরা মিলে চার শিক্ষার্থীকে মারধর করেন। তাদের মধ্যে দু’জনকে চিকিৎসার জন্য শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিও করতে হয়।

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘হাফ ভাড়া’ আদায় বাধ্যতামূলক ও পরিবহন শ্রমিকদের সদাচরণের দাবিতে আন্দোলনরত ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, মিরপুর সড়ক দিয়ে চলা বেশ কয়েকটি বাসে ওঠার পর শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়ার কথা বললে খারাপ আচারণ করা হয়। শিক্ষার্থীদের নানাভাবে অপমান করা হয়, নানারকম কটূ বাক্য শোনায়। এমনকি বাস থেকে নেমে যাওয়ার জন্যও বলে। অথচ আগে শিক্ষার্থী পরিচয় দিলেই হাফ ভাড়া নিত। করোনা পরবর্তী সময়ে পরিবহন শ্রমিকরা কিছুই মানছেন না। আমাদের সুস্পষ্ট দাবি— শিক্ষার্থীদের হাফ পাস চালু করতে হবে। অন্যথায় লাগাতার আন্দোলন করা হবে।

নিউমার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন

আরেক শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম বলেন, একটি বাসে মোট সিটের ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ৪০ সিটের গাড়িতে অন্তত ১৬টি সিটে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নেওয়ার বিধান রয়েছে। সেই নিয়ম হেলপাররা মানেন না। অন্যদিকে কিন্তু তারা পুরো ভাড়া নিলেও মালিককে এই ১৬ সিটের অর্ধেক ভাড়াই বুঝিয়ে দেয়। যা হোক, সেটি তাদের বিষয়। আমরা চাই হাফ পাস সবাইকে মানতে হবে।

ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী রোজিনা খাতুন বলেন, মিরপুর থেকে প্রতিদিন এসে ক্লাস করি। এত দিন বাসে হাফ ভাড়া নিলেও হঠাৎ করে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। ৪০ টাকা ভাড়া হলে আগে ২০ টাকা নিতো। এখন ৫০ টাকা ভাড়া কিন্তু ২৫ টাকা নিতে চায় না। তারা ৩০ টাকার কম নিতে চায় না। না দিলে তারা নেমে যেতে বলেন। এটা রীতিমত অপমান। বহু বছর ধরেই হাফ ভাড়া দিচ্ছি কিন্তু হঠাৎ করে কেন বন্ধ হবে তা বুঝতে পারছি না। এটা বাস চালক ও কন্ডাক্টরদের একটা টাকা মেরে দেওয়ার কৌশল।

শিক্ষার্থীদের ‘হাফ পাস’ দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিহঙ্গ পরিবহনের (একাংশ) পঙ্কজ দেবনাথ সারাবাংলাকে বলেন, “প্রতিটি গাড়িতে অন্তত ১৬টি সিটের ভাড়া ‘হাফ পাস’ করা রয়েছে। এগুলো ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ। কোনো বাসে এর বেশি হলে শিক্ষার্থী উঠলে তখন দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে বেশিরভাগ বাসেই প্রতি ট্রিপে ১৬টি সিটের বিপরীতে শিক্ষার্থী ওঠেন না বরং কম ওঠেন। তবুও মালিকদের টাকা দেওয়ার সময় চালক-সহকারীরা ১৬টি সিটের হাফ ভাড়া দিয়ে থাকেন।”

তাহলে শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়া দিতে চাইলে কেন পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কেন বিবাদ ঘটছে— এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক শেখ মাহবুব ই রাব্বানি সারাবাংলাকে বলেন, রুট অনুযায়ী প্রতিটি বাসেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার কথা বলা আছে। প্রতিটি বাসে অন্তত ৪০ শতাংশ সিটের জন্য ‘হাফ পাস’ প্রযোজ্য রাখার বিধান আছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

অর্ধেক ভাড়া পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হাফ পাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর