ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বৈদেশিক শ্রমবাজার, বাড়ছে নতুন চাহিদা
২২ নভেম্বর ২০২১ ১৪:৫০
ঢাকা: মহামারি করোনার রেশ কাটিয়ে প্রায় দেড় বছর পর জনশক্তি রফতানি বাড়তে শুরু করেছে। আগের বছরে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন কর্মী পাঠাতে পারলেও চলতি বছরের দশ মাসেই এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩২ জনে। জনশক্তি রফতানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন করে শুরু হতে যাওয়া শ্রমবাজারে কোথাও কোথাও কাজের ধরনও পাল্টে গেছে। তাই এই বাজার ধরে রাখতে বেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দক্ষ কর্মী পাঠানোর বিকল্প নেই বলে মত বিশেষজ্ঞদের। শ্রমবাজার ধরে রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষন ব্যুরো- বিএমইটি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গত দশ মাসে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩২ জন কর্মী বিদেশে যেতে পেরেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৫ হাজার ৭৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৯ হাজার ৫১০ জন, মার্চে ৬১ হাজার ৬৫৩ জন, এপ্রিলে ৩৪ হাজার ১৪৫ জন, মে মাসে ১৪ হাজার ২০০ জন, জুনে ৪৮ হাজার ৫৬৭ জন, জুলাইয়ে ১২ হাজার ৩০০ জন, আগস্ট মাসে ১৯ হাজার ৬০৪ জন, সেপ্টেম্বরে ৪২ হাজার ০৮ জন এবং অক্টোবরে ৬৫ হাজার ২৩৩ জন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছে সৌদি আরবে গেছে ২ লাখ ৯৮ হাজার ২৯০ জন। শতকরা ৭৮ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছে ৫ হাজার ৮৫৭ জন, কুয়েতে ৪৭৬ জন, ওমান ২৯ হাজার ৩৮০ জন, কাতার ৮ হাজার ২৮৯ জন, বাহরাইনে মাত্র ৯ জন যেতে পেরেছে এরমধ্যে জানুয়ারিতে ২ জন আর এপ্রিল মাসে ৭ জন গেছে। লেবাননে গেছে ১৫১ জন, জর্ডানে ১০ হাজার ২১০ জন, লিবিয়াতে তিন জন এদের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ২ জন আর মে মাসে গেছে ১ জন কর্মী। সুদানে গেছে ১৭ জন, মালয়েশিয়া ১৮ জন, সিঙ্গাপুর ১৬ হাজার ১১১ জন, ইউকে ৬৬ জন, ইতালিতে ৩৮৯ জন, জাপানে ৩ জন, মিশরে একজন যেতে পারেনি, ব্রুনাইয়ে ১০ জন, মরিশাস ৫৮ জন, ইরাকে ৪ জন, অন্যান্য দেশ মিলিয়ে আরও গেছে ৫ হাজার ১৫৮ জন। সবচেয়ে কম কর্মী গেছে কুয়েত, বাহরাইন, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, মিশর, ইরাক, জাপান, ব্রুনাই, মরিশাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার সমৃদ্ধ দেশগুলোতে। গত দশ মাসে যে সংখ্যক কর্মী পাঠানো গেছে শতকরা হিসাবে ০%।
সূত্র অনুযায়ী এর মধ্যে নারী কর্মীদের সংখ্যা ৫৭ হাজার ৬১৭ জন। এদিক থেকে সৌদি আরবে গমনের সংখ্যা ছিল বেশি ৩৯ হাজার ৪৫৭ জন। এরপরের অবস্থান জর্ডান, সেখানে নারী কর্মী পাঠানোর সংখ্যা ১০ হাজার ৮২ জন।
জনশক্তি রফতানির গত ৫ বছরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন, ২০১৮ সালে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন, ২০১৯ সালে মাত্র ৭০ হাজার ১৫৯ জন, ২০২০ সালে গেছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন, আর চলতি বছরের দশ মাসে গেল ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩২ জন কর্মী বিদেশে গেছে।
তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে মহামারি করোনার কারণে ২০১৯ ও ২০২০ সালে সবচেয়ে কম কর্মী পাঠানো গেছে।
বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছর বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ কর্মী নিয়োগ বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর যখন শুরু হলো তখন বেশ কিছু দেশ শ্রমজীবী নিয়োগে তাদের পলিসিতেই পরিবর্তন এনেছে।
এ প্রসঙ্গে বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে তো প্রায় দুই বছর বন্ধই থাকল। এখন শ্রমবাজার একে একে খুলতে শুরু করেছে। সৌদি আরব এখন আগের মতোই জমজমাট হচ্ছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত শ্রমিক নেওয়া শুরু করেছে। সেখানে একটা বড় সুখের খবর। এ সব দেশে শ্রমিক যাওয়া শুরু করেছে। পাশাপাশি অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়াতে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা দ্রুত শেষ হতে যাচ্ছে। হয়ত ডিসেম্বরের মধ্যেই এ সংকট কেটে যাবে। যে কারণে ভবিষ্যতে জনশক্তি রফতানির বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।’
তবে জনশক্তি রফতানি নিয়ে কাজ করছে এমন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বলছে, করোনা মহামারি কাটিয়ে ওঠার পর দেখা যাচ্ছে শ্রমবাজারগুলোতে কাজেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আরও বেশি দক্ষ করে বাজারে পাঠানোর পরামর্শ তাদের।
এ প্রসঙ্গে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম- ওকাপ চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে গত দুই বছর শ্রমবাজারে বড় ধরনের ধ্বস যে নেমেছিল এটা বড় ফ্যাক্ট। আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে ধরনের শ্রমিক প্রয়োজন শ্রমবাজারে, সে ধরনের শ্রমিক আসলে আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। কারন এখন অনেক দেশই তাদের বিভিন্ন খাতে দক্ষ শ্রমিক ডিমান্ড করছে। আমাদের দেশে সাধারণত কম দক্ষ শ্রমিকরা যায়, যে কারণে দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা যেখানে সে জায়গাটা ধরা যাচ্ছে না। এটি জনশক্তি রফতানি কমে যাওয়ার বড় কারণ।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে না পারি তাহলে করোনা পরবর্তী সময়ে এর চাহিদা কম হবে। অন্যদিকে আমাদের বড় একটা অংশ নারী শ্রমিক পাঠানো। তাদের ক্ষেত্রে সরকারকে আরো উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন নারী কর্মী পাঠানোর ২০১৫ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে সরকার একটা সমঝোতা স্মারক সই করে। শুরুর দিকে কিছু কাজ হলেও পরবর্তীতে তার প্রতিফলন আমরা কখনও দেখিনি। যে সকল দেশে নারী শ্রমিক যাচ্ছে সেসব দেশে সরকারকে সমঝোতা স্মারক কিংবা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে হবে। যাতে করে দেশের নারী শ্রমিকরা কোনো ধরনের হয়রানি, প্রতারণা, নির্যাতনের শিকার না হয়।’
এদিকে শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বর্তমানে ৬৮টি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৪৮টি ট্রেড উন্নীত করে ৭৬ টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিএমইটির আওতায় ৪৮টি টিটিসিতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ ২১ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিন বাড়িয়ে হাউজ কিপিং ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। হাউজ কিপিং এ আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে কাজ করছে। আন্তর্জাতিকমানের কর্মী গড়ে তুলতে টিটিসি কর্তৃক বেশ কিছু কারিগরি প্রশিক্ষণ চলমান। এ ছাড়া শিক্ষামান উন্নয়নের লক্ষ্যে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় আইডিবির আর্থিক সহায়তায় ঢাকা টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনা মহামারি কাটিয়ে বর্তমানে বিদেশে কর্মী গমনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। গত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মোট দেড় লাখের বেশি কর্মী কর্মসংস্থানের উদ্দেশে বিদেশে গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র আসছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের হার কোভিড পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে এসেছে। এই প্রবাহ চলমান থাকলে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা কমলেও খুব শিগগিরই এটি ঊর্ধ্বমুখী হবে। আমরা শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। নানামুখি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ চলমান।’
সারাবাংলা/জেআর/একে