অনিয়মে আটকে আছে জবির নতুন ক্যাম্পাসের কাজ
২৩ নভেম্বর ২০২১ ০৮:১৫
জবি: ২০০৫ সালে দেশের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের অবকাঠামোতে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা ও অবকাঠামো সংকট থাকায় শিক্ষার্থীদের নানা আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেন তিনি। এরপর ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক সভা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নানা অনিয়মে আটকে গেছে নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজ। বছরের পর বছর গড়ালেও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পের ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ টাকার মধ্যে ভূমি উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও প্রকৌশল ভবন নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, লেক খনন, পুকুর খনন, ঘাট নির্মাণ, সংযোগ সেতু নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ সারফেস ড্রেন নির্মাণের কাজও এখনও শুরু হয়নি। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কেরানীগঞ্জে ক্যাম্পাস নির্মাণের সিদ্ধান্তের পাঁচ বছর পার হলেও জমি অধিগ্রহণ ছাড়া কোনো কাজ হয়নি।
এর মধ্যে, চলতি বছরের ১৬ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) নতুন ক্যাম্পাসের লেক নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে চারটি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। যদিও কাজ করার জন্য একটি কোম্পানিকে নির্দিষ্ট করে মন্ত্রণালয়ের পাঠানোর আগেই পুরো প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন ক্যাম্পাসের কাজ থমকে আছে মূলত মাস্টারপ্ল্যান ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে অনিয়ম ও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ের দেওয়ার পাঁয়তারার জন্য। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ তিন দফায় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ব্যয়ও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৪১.৪ কোটি টাকা।
জানা যায়, ২০১৯ সালে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য ২৯ কোটি ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকার ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপিতে জিওবির অর্থায়নে মাস্টারপ্ল্যান এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান খাতে ৩০ কোটি টাকা রাখা হয়।
২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বিজ্ঞপ্তির পর ২১ মার্চ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য ১৮টি প্রতিষ্ঠানের এক্সপ্রেস অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) গ্রহণ করে। ৩০ নভেম্বর প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ তিনটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরএফপি-এর চাহিদা অনুযায়ী টেকনিক্যাল ও ফিন্যান্সিয়াল প্রস্তাব দাখিল করে।
এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সৃজনী উপদেষ্টা লিমিটেডের কারিগরি মূল্যায়নে সর্বোচ্চ স্কোর অর্জন করে এবং তাদের সেবার মূল্য ৪ কোটি ৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা। কিন্তু ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান নিয়ম অমান্য করে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘আরবানা’কে ২১ কোটি ৬০ লাখ টাকা নির্ধারণ করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিয়োগে সুপারিশ করে। এ প্রক্রিয়ায় আরেকটি প্রতিষ্ঠান ডিপ্লোমেন্ট ডিজাইন কনসালটেন্স লিমিটেড ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকায় সেবার মূল্য নির্ধারণ করে।
যে কারণে, গত ১১ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ আর্থিক বার্ষিক কর্মসূচির সভায় ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগ ও মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের জন্য ক্রয় প্রক্রিয়া পিপিআর অনুযায়ী না হওয়ায় মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নাকচ করে দেয়।
একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি কম্পোনেটের ‘ইআইও’ আহ্বান করেন। বিষয়টি বিব্রতকর উল্লেখ করে ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য এবং পিপিআর মেনে চলতে সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ জানানো হয়।
এরপরও প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন মাস্টারপ্ল্যানের কাজের জন্য সিঙ্গেল চয়েজের ভিত্তিতে ফের ‘আরবানা’ কোম্পানিকে প্রায় ৫ কোটি টাকায় কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ একর জমির মাস্টারপ্ল্যানের জন্য কমপক্ষে ১০০ একর জমিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু আরবানা কোম্পানির সেই অভিজ্ঞতা নেই।
আরবানা কোম্পানির মালিক গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের ছেলে কাশেফ চৌধুরী। এ কোম্পানির সঙ্গে গণপূর্ত বিভাগের সাবেক প্রকৌশলী প্রকল্প পরিচালক শাহাদাত হোসেন ও পরিকল্পনা উন্নয়ন ওয়ার্কসের উপপরিচালক নাইলা ইয়াসমিন পূর্বপরিচিত। অভিযোগ নাইলা ইয়াসমিন আরবানা কোম্পানির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন। দরপত্রের বিভিন্ন তথ্য নির্দিষ্ট কোম্পানিকে দেওয়ার অভিযোগও আছে তার নামে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প শুরুর পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়ম না মেনে আরবানার কাছ থেকে একটি মাস্টারপ্ল্যানের কাজ তৈরি করে নেন। এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরির পুরো প্রক্রিয়া নাইলা ইয়াসমিন করেছেন বলে পরিকল্পনা উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দফতরের বিভিন্ন কর্মকর্তারা জানান।
তবে নাইলা ইয়াসমিন অস্বীকার করে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না, আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।’
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মীজানুর রহমানের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ মাস্টারপ্ল্যানের চিত্র উপস্থাপন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই মাস্টারপ্ল্যানের চিত্র বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনও করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারেও এর একটি ডিজাইনও প্রকাশ করা হয়।
যদিও ২০২১ সালের ৩ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক যোগদানের পর মাস্টারপ্ল্যানের কোম্পানি নিয়োগে জটিলতা ও অনিয়মের কারণে পুরো প্রক্রিয়া বাতিল করেন। গত ২৩ আগস্ট মাস্টারপ্ল্যানের জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু প্রক্রিয়া শুরুর ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো দরপত্র প্রকাশ করা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি মাস্টারপ্ল্যান উপস্থাপন করা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে এ সভায় কারা উপস্থিত ছিলেন, আর ডিজাইনটি কাদের তৈরি করা ছিল সে বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
বিশ্ববিদ্যালয় চিফ ইঞ্জিনিয়ার প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘নতুন ক্যাম্পাসের সীমানা প্রাচীরের দরপত্র অনুমোদন হয়েছে। দ্রুতই সীমানা প্রাচীরের কাজ শুরু হবে। আর মাস্টারপ্ল্যানের জন্য পুনঃদরপত্র দেওয়া হবে। উপাচার্যের কাছে এ বিষয়ে একটি ফাইল দেওয়া হয়েছে। উনি বললেই দরপত্র আহ্বান করা হবে।’
নতুন ক্যাম্পাসের কাজের অগ্রগতি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক বলেন, ‘নতুন ক্যাম্পাসের কাজের মাস্টারপ্ল্যানের দরপত্রে জটিলতা ছিল। আগের পুরো প্রক্রিয়া বাতিল করে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। আগের প্রক্রিয়ায় অনিয়মের সঙ্গে যদি কেউ জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ কাজ দ্রুত করার জন্য ইউজিসি, মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একাধিক বৈঠক করেছে বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলা/এমও
অনিয়ম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় জবির নতুন ক্যাম্পাস নতুন ক্যাম্পাস