নারীর প্রতি সহিংসতা ইস্যুতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যই যথেষ্ট নয়
২৫ নভেম্বর ২০২১ ২২:৫৩
ঢাকা: নারীর প্রতি সহিংসতা ইস্যুতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও জাতীয় মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।
বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়নে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ডা. ফওজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড লবি পরিচালক অ্যাড. মাকছুদা আখতার। জানানো হয়, “নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ কর, সমঅধিকার নিশ্চিত কর”- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে এবছর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস (২৫ নভেম্বর-১০ ডিসেম্বর)’২১ পালনের লক্ষ্যে কেন্দ্রসহ জেলা শাখাসমূহে ১৫ দিনব্যাপী বহুমূখি কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার ইস্যূতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যই যথেষ্ট নয়। তবে প্রকাশিত তথ্যসমূহের আলোকে সংগঠন সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য আইনী সহায়তা দিয়ে থাকে, তাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহায়তা করে। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কেন্দ্র ও জেলা পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে, বাস্তবমুখী পদক্ষেপও গ্রহণ করে থাকে। নারীরাও অনেক সময় নারীদের নির্যাতন করছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন পুরুষের দ্বারা নারী নির্যাতনের সংখ্যার তুলনায় নারী কর্তৃক নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা কেমন সেটি দেখতে হবে। নারীকে নির্যাতনের পেছনে সামাজিক সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, পারিবারিক শিক্ষা, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব অনেকাংশে দায়ী। নারী আন্দোলন এর বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্চার। তিনি এসময় নারী নির্যাতনকারী হলেই তার দায় নারী আন্দোলনের উপর না দেয়ার জন্য গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন এই দায় সমাজের, সামাজিক প্রেক্ষিতের। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য করণীয় হিসেবে তিনি বলেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতির সমন্বিত পরিবর্তন করতে হবে; সহিংসতার শিকার নারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে; বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করে নারীর প্রতি সংবেদনশীল বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, প্রচলিত আইনের সংস্কার করতে হবে। ধর্ষণের আইন সংশোধন করা হলেও এর তেমন প্রচার নেই, প্রয়োগের ক্ষেত্রও সীমিত। এমতাবস্থায় তিনি মিডিয়াকে নিয়মিত তথ্য দিয়ে সহায়তার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।
সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নে লক্ষনীয় অগ্রগতি সাধিত হলেও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এখনো সম্ভব হয়নি। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নারী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন এবং সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেত্ত নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা ও ভয়াবহতা ক্রমাগত উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাত এই সংকটকে গভীরতর করে তুলেছে। লিখিত বক্তব্যে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য ‘সকলক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করা’ কে অন্যতম শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে গৃহীত সকল কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৬ টি সুপারিশ তুলে ধরা হয় —
১. পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করে নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে।
২. মানবাধিকার সম্পর্কে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে।
৩. নারীর জন্য ক্ষতিকর প্রথা (বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পারিবারিক সহিংসতা, বিচার বহির্ভূত সালিশী কার্যক্রম, বহুবিবাহ) বন্ধ করতে হবে।
৪. আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও বিচারিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত সকলকে নারীবান্ধব ও জেন্ডার সংবেদনশীল করে তুলতে হবে। সিডওসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলসমূহ প্রশিক্ষণের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
৫. পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০ এর প্রচার ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৬. ধর্ষণের ঘটনার বিচার সংক্রান্ত আইনের সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।
৭. অপরাধীকে কোনরকম রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদান বন্ধ করতে হবে।
৮. সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সমাবেশের নামে নারীর প্রতি নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা (অনলাইন, অফলাইন) কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
৯. গণমাধ্যমে নারীর প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য, ছবি প্রকাশ ও প্রচারনা বন্ধ করতে হবে।
১০. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নরোধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
১১. নির্যাতনের শিকার নারীকে দোষারোপ করা বন্ধ করতে হবে।
১২. তরুণ সমাজকে পরিকল্পিতভাবে মানবাধিকারে উদ্বুদ্ধ করে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
১৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
১৪. সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ধারা ১৫৫ (৪) বাতিল করতে হবে।
১৫. জাতিসংঘের সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ) এর উপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
১৬. বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করতে হবে (বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়সমূহ)।
উক্ত সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি, নাগরিক সমাজের প্রতি, তরুণ সমাজের প্রতি, গণমাধ্যমের প্রতি এবং পরিবার ও নারীসমাজের প্রতি এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম, লিগ্যাল এইড সম্পাদক সাহানা কবীর, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক এবং গণমাধ্যম সম্পাদক(ভারপ্রাপ্ত) রীনা আহমেদ ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রেহানা ইউনূস এবং সংগঠনের আইনজীবী অ্যাড. রাম লাল রাহা, অ্যাড. ফাতেমা খাতুনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সংগঠক ও কর্মীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন সংগঠনের আইনজীবী অ্যাড. দীপ্তি সিকদার।
সারাবাংলা/আরএফ/
আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ জাতীয় মহিলা পরিষদ জাতীয় মানবাধিকার দিবস