Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘মাইনুদ্দিনকে বাস চাপা দিয়েছে, আপনারা আসেন’

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৩০ নভেম্বর ২০২১ ০৯:৩৪

ঢাকা: মাত্র কয়েকদিন হলো এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছিল মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। ভালো একটি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য বারবার বলছিল বাবাকে। দিনের বেশির ভাগ সময়ই কাটাতো বাবা-মায়ের চায়ের দোকানে। সোমবারও বিকেল থেকে বাবার সাথে দোকানেই ছিল মাইনুদ্দিন। রাত ৮টার দিকে এক বন্ধুর সাথে দেখা করার কথা বলে দোকান থেকে চলে যায় রামপুরা বাজারের কাছে। আর রাত ৯টা ৫০ মিনিটে তার ফোন থেকে এক পথচারী ফোন করে তার স্বজনদের জানায়, ‘মাইনুদ্দিনকে বাসে চাপা দিয়েছে। সড়কে পড়ে আছে, আপনারা আসেন। পরিবারের লোকজন ছুটে গিয়ে দেখেন মাইনুদ্দিনের নিথর দেহ পড়ে আছে সড়কে।’

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২৯ নভেম্বর) দিবাগত রাত ২টার দিকে পূর্ব রামপুরার তিতাস সড়কে ভাড়া বাসায় নিহত মাইনুদ্দিনের বেয়াই সারাবাংলাকে এসব কথা বলেন। এসময় পাশেই মাইনুদ্দিনের বাবা আব্দুর রহমান ও তার মা রাশিদা বেগম বিলাপ করে কাঁদছিলেন।

বাবা কান্নাকাটি করে বলছিলেন, ‘আমার মাইনুদ্দিন কই। সে যে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেল। সে এখনো কেন এলো না। তাকে ফোন করে ডেকে আনো। সে আমাকে কেন ফোন করছে না।’

‘বাবা আমার পরীক্ষা দিলো। অনেক দিন ধরেই আমাকে বলছিল, আব্বা আমাকে একটা ভালো কলেজে ভর্তি করাবেন। আমি ভালো কলেজে পড়তে চাই। ভালো রেজাল্ট করে বড় হতে চাই। আমি তো তার জন্য খেয়ে না খেয়ে টাকা জোগার করছিলাম। তাকে ভালো কলেজে ভর্তির জন্য কলেজেও খুঁজছিলাম। এখন কাকে কোথায় ভর্তি করাবো? বাপরে তুই কোথায়? বাপরে তুই বুকে আয়’, বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন সন্তান হারানো বাবা।

অনাবিল পরিবহনের চাপায় এসএসসি পরীক্ষার্থী নিহত, ৮ বাসে আগুন

পাশাপাশি বসে মা রাশিদা বেগমও আবোলতাবোল বলছিলেন। কয়েকজন স্বজন মাকে স্বান্তনা দিচ্ছিলেন। মা বলছিলেন, ‘বাবারে তোর জন্য আমরা কি না কষ্ট করছি? তোকে বড় করার জন্য কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল। তার সবই শেষ হলোরে। তুই কেন গেলিরে বাবা। তুই তো দোকানেই ছিলি। আব্বারে আব্বা তুই মুরগীর মাংস ছাড়া ভাত খাস না! মুরগীর মাংস রাঁধছি, কোথায় তুই খাবি না?’

এসময় সেখানে উপস্থিত সকলে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। রাতের পরিবেশ নিস্তব্ধ থাকলেও তিতাস সড়ক তার ব্যতিক্রম। পুরো এলাকা শোকাহত। তিতাস সড়কের বাসিন্দা হাসান আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা মেনে নিতে পারছি না। নম্র-ভদ্র ছেলেটাকে সন্ধ্যা বেলায় চায়ের দোকানে দেখে এলাম। রাত ১০টায় শুনি সে নিহত, কেমনে সম্ভব এটা!’

বিজ্ঞাপন

তিতাস সড়কের আগে জাকের সড়কের বাসিন্দা জুলফিকার হায়দার বলেন, ‘মাইনুদ্দিন পুর্ব রামপুরার শেষ মাথা তিতাস সড়কে থাকলেও পুরো এলাকার লোকজন তাকে চিনতো। এই এলাকাতেই তার বেড়ে ওঠা, খেলাধূলা আর পড়াশোনা।’

মুল সড়কের পাশে (ঘটনাস্থলের) স্টেশনারি দোকানদার আদিত্য চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাছাকাছি না হওয়ায় আমার দোকানে আসত। আমি তাকে ভালোভাবে চিনতাম। ভালো একটা ছেলে ছিল।’

নিহত মাইনুদ্দিনের বেয়াই বলেন, ‘মাইনুদ্দিন বড় হয়ে প্রশাসনের ক্যাডার হতে চেয়েছিল। সে প্রায়ই বলতো, লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করবে প্রশাসন ক্যাডারে। বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে সে পড়ত আর দোকানে কাজ করত। নম্র-ভদ্র ছিলো তার আচরণ।’

বিক্ষুব্ধ জনতা বাসে আগুন দিয়েছে
মাইনুদ্দিনের বেয়াই সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাত ৯টা ৫০ মিনিটে প্রথম আমার ফোনে তার ফোন থেকে কল আসে। একজন জানায় মাইনুদ্দিন বাসচাপায় সড়কে পড়ে আছে। আমি ও আমার বড়ভাই সাদ্দাম হোসেন (মাইনুদ্দিনের দুলাভাই) গিয়ে দেখি সে পড়ে আছে। রক্ত ভেসে যাচ্ছে। মাথা নেই, চেনার উপায় নেই। চারদিকে বাসে আগুন জ্বলছে। কারা এসব বাসে আগুন দিলো এত তাড়াতাড়ি তাও বুঝে উঠতে পারি নাই। মাইনুদ্দিনের এসব পরিস্থিতি দেখে সাদ্দাম ভাই শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনিও এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাসে আগুন দেওয়া ও ভাঙচুরের বিষয়ে আমাদের কোনো হাত নেই। আশপাশের বহিরাগত বিক্ষুব্ধ লোকজনই এসব বাসে আগুন দিয়েছে ও ভাঙচুর চালিয়েছে। আমরা ওসিকে সহযোগিতা করেছি যাতে আর কোনো গাড়িতে কেউ আগুন দিতে না পারে।’

রামপুরা মালিবাগ সড়কে দুর্ঘটনাকবলিত স্থানের আশেপাশের কমপক্ষে ১০ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন সারাবাংলার প্রতিবেদক। তাতে বোঝা যায় বাসে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। হাসান নামে একজন বলেন, ‘মাইনুদ্দিন পশ্চিম দিক থেকে রাস্তা পার হয়ে পূর্বদিকে আসছিল। এসময় দুটি বাস (রাইদা ও অনাবিল) পাল্লাপাল্লি করছিল। তখন অনাবিল বাসের চাকায় পিষ্ট হয় মাইনুদ্দিন। মাইনুদ্দিনের রাস্তা পার হওয়া আশেপাশের লোকজন দেখে চিনে ফেলে। হইচই করে উঠে কেউ একজন বাসটিতে আগুন ধরায়। এটা দেখে দুই পাশের সড়কে থাকা বাসগুলোতে প্রথমে ভাঙচুর চালানো হয় এবং শেষে আগুন দেওয়া হয়।’

ঘটনাস্থলে পুলিশ আসতে দেরি করায় একের পর বাসে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। আর স্বল্প সংখ্যক পুলিশ আসায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়। তবে রাত ২টার দিকে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

সারাবাংলা/ইউজে/এমও

বাস চাপা বাসচাপায় মৃত্যু মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর