গণমাধ্যমের সংখ্যা ধারণক্ষমতার বেশি কি না— ভাবতে বলছেন হানিফ
২ ডিসেম্বর ২০২১ ১৭:১১
ঢাকা: দেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ৩০টির বেশি। এর বাইরে রয়েছে কয়েকশ দৈনিক পত্রিকা। অনলাইনের সংখ্যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে এত বিপুলসংখ্যক গণমাধ্যমের প্রয়োজন রয়েছে কি না— সেটি ভেবে দেখতে বলেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ।
বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বিবার্তা২৪ ডটনেট ও জাগরণ টিভি আয়োজিত ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম: ভূমিকা ও সংকট’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। গণমাধ্যমের এই বিপুল সংখ্যার কারণে এই খাতটিতে নানা সংকট রয়েছে বলেও জানান তিনি।
গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির অনিশ্চয়তার পেছনে বিনিয়োগকারীদের ব্যাবসায়িক চিন্তাধারা, বিজ্ঞাপনের বাজার অনুপাতে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেশি হওয়াকে দায়ী করেন মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি বলেন, বিজ্ঞাপনের বাজার অনুপাতে গণমাধ্যমকে লাইসেন্স দেওয়া ও নেওয়া হলে বেতন ও কর্মচারী সংকট তৈরি হতো না। সংকট নিসরনে গণমাধ্যমে করপোরেট কালচার গড়ে তোলা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
দেশে গণমাধ্যম পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে দাবি করে হানিফ বলেন, দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে টকশো ও অনুষ্ঠানে আলোচকরা কোনো ধরনের সেন্সর ছাড়া সরকারের কর্মকাণ্ডের যথেচ্ছা সমালোচনা করেন। এ ধরনের স্বাধীন মতপ্রকাশে সরকার কখনো হস্তক্ষেপ করে না, কোনো ধরনের বাধা তৈরি করে না।
অনুষ্ঠানে বক্তারা গণমাধ্যমকে জনগণের ভরসার শেষ ঠিকানা হিসেবে মন্তব্য করেন। তারা বলেন, গণমাধ্যম জাতির আয়না, যে আয়নায় ভেসে ওঠে জাতি ও দেশের প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবি যারা ফুটিয়ে তোলেন তারা কেমন আছেন— এ প্রশ্নও রাখেন তারা। প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে গণমাধ্যকর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে উল্লেখ করে তারা সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও সংকট নিরসনে গণমাধ্যমের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা হওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন।
গোলটেবিল আলোচনা সভায় কি-নোট স্পিকারের বক্তব্যে জিটিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যম নাগরিকের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখে, তথ্য জগতে তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। মানুষ জানতে চায়, মানুষ সমাজের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়। গণমাধ্যমের ভূমিকা সেখানেই। নীতিনির্ধারক, আইন সভাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ ঘটাতে ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম। এতে দেশের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা প্রতিফলিত হয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম মানুষের প্রতিটি গণতান্ত্রিক, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের সঙ্গে থেকেছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যম নানা ঐতিহাসিক ঘটনায়, মানুষের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে। দুর্নীতি, সহিংসতার ইস্যুকে অনেক সময় গণমাধ্যমই সবার আগে মানুষের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে।
আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান বলেন, আমরা অনেক কিছুই বলছি, লিখছি। কিন্তু আমরা অনেক কিছুই প্রকাশ করছি না। এর অর্থ— আমাদের নিজেদের ভেতরেই স্ববিরোধিতা আছে। আমরা নিজেরাই অনেক সময় বাংলাদেশ বেতার বা বাংলাদেশ টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমের সমালোচনা করি, যখন দেখি গণমাধ্যম জনমুখী ভূমিকা রাখছে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যেমন অনেক বেশি তথ্যবহুল সংবাদ পরিবেশন করা যায়, তেমনি খুব দ্রুত গুজবও ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যারা এর সুষ্ঠু ব্যবহার করে সংবাদ প্রকাশ করছেন তারা কিন্তু ঠিকই সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নিচ্ছেন। এর অসংখ্য উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। আইপি টিভির একসময় অবাধ বিচরণ ছিল। যাচ্ছেতাই মনগড়া সংবাদ পরিবেশন করত তারা। আশার কথা, সম্প্রতি সরকার আইপি টিভির জন্যও নীতিমালা করে দিয়েছে।
ডিবিসি নিউজের সম্পাদক প্রণব সাহা বলেছেন, সাংবাদিকদের তথ্যপ্রবাহের জন্য প্রতিদিনই পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সাংবাদিকরা কাঁটা বিছানো পথে হাঁটা মানুষ। প্রতিনিয়ত তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হচ্ছে। এই গণমাধ্যমের সংকটও শেষ হবে না। কিন্তু আমাদের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সাংবাদিকদের মনে রাখতে হবে, সাংবাদিকতা করলে দেশের ও সমাজের খারাপ দেখলে সমালোচনা করতেই হবে।
দেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এগিয়ে নিতে ফেসবুক ও ইউটিউবের একচেটিয়া মনোপলি ব্যবসা বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ঢাকা পোস্টের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন ফেসবুক ও ইউটিউবের বড় বিজ্ঞাপন বাজার হলেও দুর্ভাগ্য হলো— এসব প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হলেও আমাদের সবচেয়ে কম রেট দেওয়া হয়। দেশীয় বিজ্ঞাপন ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচার হচ্ছে। স্থানীয় পত্রিকা কিছু বিজ্ঞাপন পায়, টেলিভিশনে আস্তে আস্তে এ খাত থেকে আয় সংকুচিত হয়ে আসছে। ফেসবুক ও ইউটিউবের এই একচেটিয়া মনোপলি ব্যবসা বন্ধে সরকার উদ্যোগ না দিলে ডিজিটাল মিডিয়া এগোতে পারবে না।
নিউজ ২৪ এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক আঙ্গুর নাহার মন্টি বলেন, মূলধারার সাংবাদিকতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে সোস্যাল মিডিয়া। বর্তমানে গণমাধ্যম নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ— সাংবাদিকতা ও সংবাদকর্মীরা একেবারেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আস্থার সেই জায়গাটা সাধারণ মানুষের কাছে আর নেই।
হতাশা জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে সাংবাদিকরা চাকরি করছেন মাত্র। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে আমাদের নীতি-নৈতিকতা কী হবে সেটি ঠিক করার দায়িত্ব যেমন সাংবাদিকদের আছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানেরও আছে। এখনো আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোন ধরনের নীতিমালার বালাই নেই। টিভিগুলোর অবস্থা আরও হযবরল অবস্থা। আমরা মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলি, কিন্তু আমাদের নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বিবার্তা২৪ ডটনেটের সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি বলেন, আমি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে একটি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক। কাজেই সাংবাদিকতাকে দুই দিক থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার মতে, সাংবাদিকতা হচ্ছে থ্যাংকলেস জব। এখানে ভালো কাজ করলে কেউ ধন্যবাদ দেবে না। আবার নাম আগে-পরের জন্যও অনেকে চার্জ করার জন্য বসে থাকে। এই খাতে সংকট রয়েছে, সংকট থাকবে। তবে একে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হবে। আর যদি এ পেশার চাপের কথা বলি, তাহলে এ চাপটা সরকার ও রাজনৈতিক দল থেকে না, এটা নিজের ভেতর থেকে আসে।
জাগরণ টিভি’র প্রধান সম্পাদক এফ এম শাহীনের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট কুহেলী কুদ্দুস মুক্তি, মাহমুদ সালাউদ্দিন চৌধুরী, হাবিবুর রহমান রোমেল, নাজমুল হক সিদ্দিক, বরিকুল ইসলাম বাঁধন, এস এম রাকিবুল হাসান, রবিউল রূপমসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
আঙ্গুর নাহার মন্টি এফ এম শাহীন গণমাধ্যম গণমাধ্যমের সংকট গোলাম রহমান টপ নিউজ পরিবর্তিত পরিস্থিতি প্রণব সাহা বাণী ইয়াসমিন হাসি মহিউদ্দিন সরকার মাহবুবউল আলম হানিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা