জনশক্তি রফতানিতে বাড়ছে নারী, দক্ষ শ্রমিক পাঠানোই বড় চ্যালেঞ্জ
২ ডিসেম্বর ২০২১ ২৩:১০
ঢাকা: বৈদেশিক শ্রমবাজারে পুরুষের সংখ্যা কমে এলেও গত কয়েক বছরে নারী কর্মীদের হার বেড়েছে। যদিও গত বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এর গতি কিছুটা টেনে ধরেছিল। তবে চলতি বছর ফের বাড়তে শুরু করেছে। গত ১০ মাসে ৫৭ হাজার ৬১৭ জন নারী কর্মী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী দুই মাসে এ সংখ্যা হয়তো লাখের কাছাকাছি পৌঁছাবে। আর গত ত্রিশ বছরে এই সংখ্যা ৯৬ লাখ ৪ হাজার ৩১ জন। অর্থাৎ বিদেশে নারী কর্মী গমনের সংখ্যা ২৬ ভাগেরও বেশি বেড়েছে। এতে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে নারীদের প্রতি হয়রানি আর নির্যাতনের ঘটনায় সম্ভাবনাময় এ খাত এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে নারী কর্মী পাঠিয়ে কেবল সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, তাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের যোগ্যতা অনুযায়ী দক্ষ করে তোলার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, বিদেশে নারী জনশক্তি রফতানি শুরু হয় ১৯৯১ সালে। ওই বছর সৌদি আরবে ২৯ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪১৭ জন, কুয়েতে ৪১৬ জন, ওমানে ৩৭ জন, বাহারাইনে ১৪৩ জন, লেবাননে ২৫ জন, মালয়েশিয়ায় ৯২৬, সিঙ্গাপুরে এক জন, যুক্তরাজ্যে দুই জন, পাকিস্তানে এক জন, ব্রুনাইয়ে আট জন, মরিশাসে ১৭৮ এবং অন্যান্য দেশে আরও চার জনসহ মোট ২ হাজার ১৮৯ জন নারীকে বিদেশের শ্রমবাজারে পাঠানোর মধ্য দিয়ে নারী জনশক্তি রফতানি শুরু করে বাংলাদেশ। এর পরের নয় বছরে নারী কর্মী পাঠানোর সংখ্যা কমতে থাকে। এক পর্যায়ে ২০০১ সালে ৬৫৯ জনে এসে পৌঁছায়। এর পর থেকে কিছুটা বাড়তে শুরু করে। তবে তা আড়াই হাজারের ওপরে কখনো ওঠেনি।
কিন্তু মূল স্রোতটা শুরু হয় ২০১১ সালে। ওই বছর বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার ৫৭৯ জন। ২০১২ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৩০৪ জনে। আর ২০১৪ সালে ৭৬ হাজার ৭ জন নারী মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য যান। ২০১৪ সালে যান ১ লাখ ৩ হাজার ৭১৮ জন আর ২০১৬ সালে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮ জন। ২০১৭ সালে ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন বিদেশে কাজ নিয়ে যান। এরপর থেকে এ সংখ্যা কমতে শুরু করে। ২০১৮ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ জন, ২০১৯ সালে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৮৬ জন বিদেশে গেছেন। এরপর করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালে ২১ হাজার ৯৩৪ জন নারী কর্মী বিদেশে যান। এছাড়া চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৫৭ হাজার ৬১৭ জন কাজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। সব মিলিয়ে ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত গত ত্রিশ বছরে ৯৬ লাখ ৪ হাজার ৩১ জন নারী কর্মী বিদেশের শ্রম বাজারে প্রবেশ করেছে।
সূত্র মতে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, ওমান, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউকে, ইতালি, হংকং, সাইপ্রাস, ব্রুনাই, মরিশাসে নারী শ্রমিক বেশি যায়। এর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, লেবান, ওমান, বাহারাইনে বেশি সংখ্যক নারী কর্মী পাঠানো হয়। কিন্তু নানা ধরনের প্রতারণা, হয়রানি, নির্যাতন, হত্যার ঘটনাও প্রবাসে বাংলাদেশের নারীদের সঙ্গে। যে কারণে গত কয়েক বছরে সামগ্রিকভাবে নারী শ্রমিক গমনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসার সংখ্যাও কম নয়। সরকারিভাবে প্রবাসে প্রতারিত হয়ে ফিরে আসা নারীদের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বেসরকারিভাবে এর সংখ্যা কয়েক লাখ। আর গত চার বছরে ৪১৭ নারী লাশ হয়ে ফিরে এসেছে। যদিও বলা হয়, এদের মধ্যে ৫১ জন আত্মহত্যা করেছেন। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী কর্মীদের দক্ষ করে পাঠানো যায়নি বলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ৩০ বছর ধরে নারী জনশক্তি রফতানি করছে বাংলাদেশ। সময় দীর্ঘ হলেও ওভাবে নারীদের জন্য শ্রমবাজার তৈরি করা যায়নি। শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যসহ মাত্র কয়েকটি দেশে নারীদের পাঠানো হয়। এখন তার থেকেও কমে গেছে। কারণ নানা কারণে নারীদের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া আর নতুন করে কোনো বাজার তৈরি হয়নি। এখন বেশিরভাগ যায় সৌদি আরব। এর বাইরে যায় জর্ডান, লেবাননে। এখন প্রশ্ন হলো যেসব দেশে মেয়েরা যাচ্ছে সেগুলোর জন্য আমরা কী করব, বা কী করছি।’
তিনি বলেন, ‘এখানে কয়েকটি বিষয় রয়েছে, যেমন- যাওয়ার আগে কতগুলো দায়িত্ব, আবার পৌঁছানোর পর কিছু দায়িত্ব। আমি মনে করি, একজন নারী কর্মীকে পাঠানোর আগে তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অনেক নারী বিদেশে যায় যাদের ভাষাগত দক্ষতা নেই। এমন কর্মী আছে যারা কোনোদিন ঢাকায় আসেনি। কিন্তু সে চলে যাচ্ছে এমন একটা শহরে যেখানে ভাষা, খাবার, সংস্কৃতি, পোশাক, প্রযুক্তি সবই ভিন্ন। এমন পরিবেশে কর্মী পাঠাতে হলে তাকে অবশ্যই প্রাথমিক ধারণাটুকু দিয়ে পাঠানো জরুরি।’
নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রবাজার সৌদি আরব। গত ৩০ বছরে দেশটিতে গেছেন ৩ লাখ ৭২ হাজার ১৯২ জন। আর গত তিন বছর দশ মাসে গেছেন ২ লাখ ৬ হাজার ৬৪৭ জন। এর মধ্যে কাজ শেষ না করেই ফিরে এসেছেন অন্তত ১০ হাজার নারী। এসব তথ্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর। গত বছর আগস্টে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠায় বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সেখানে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা ১১০ নারী গৃহকর্মীর তথ্য দিয়ে বলা হয়, ৩৫ শতাংশ নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। আর ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন দেওয়া হয় না।
এ প্রসঙ্গে শরিফুল হাসান বলেন, ‘দালালরা সব সময় গ্রাম-গঞ্জে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, অশিক্ষিত মেয়েদের টার্গেট করে। তাতে দুই ধরনের সুবিধা। এক. হয়রানির শিকার হলে তাদের প্রতিবাদ করার পরিস্থিতি নেই। দুই. অর্থের অভাবে আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন না। নারী কর্মীদের পাঠানোর আগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে এ বিষয়গুলোতে কঠোরভাবে নজর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে সরকার নারী গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও আইনি সহায়তা দিতে সৌদি সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল বা শর্তগুলো দিয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদেশে পাঠানোর আগে তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিদেশে যাওয়ার পর তার সুবিধা অসুবিধা মনিটরিং করতে হবে। দু’দিক থেকে এ কাজগুলো করতে পারলে নারীরা প্রতারিত বা নির্যাতনের শিকার হবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে মেয়েদের বিদেশে না পাঠিয়ে তাদের দক্ষ করে যদি দেশেই বিভিন্ন কাজে লাগানো যায় তাহলে এই ধরনের ঝুঁকি থাকে না। তবে বিদেশে পাঠাতে হলে আমাদের ঠিক করতে হবে আসলে মেয়েদের কোন দেশে, কোন প্রক্রিয়ায় পাঠাব। যাওয়ার পর মনিটরিংয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। এতে নারী কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা ও তাদের ওপর নির্যাতন অনেকাংশে কমে আসবে।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, কাতারে বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক সবচেয়ে বেশী যান। সৌদি আরবে গৃহকর্মী বেশি গেলেও অন্যান্য দেশগুলোতে নারীরা পোশাক কারখানায় কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। জানা গেছে গত চার বছরে সরকারিভাবে জর্ডানের ৩৮টি পোশাক কারখানায় ১৪ হাজার নারী শ্রমিক নিয়োগ পেয়েছেন। এছাড়া নতুন নতুন কর্মীর চাহিদাও আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে দূতাবাসগুলোকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। যাতে কোনো নারী বিদেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার না হোন।
এ প্রসঙ্গে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, নারীদের জন্য নিরাপদ শ্রমবাজার তৈরি করা যায়নি। কাজের ক্ষেত্রেও গৃহকর্মীর বাইরে অন্য পেশাও প্রসারিত করা যায়নি। সে কারণে বার বার একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। নারীদের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করা গেলে শ্রমবাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে।’ তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবের সঙ্গে ২০১৫ সালে যে চুক্তি সরকার করেছিল তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া নতুন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পাশাপাশি অন্যদেশগুলোর সঙ্গেও সমঝোতা চুক্তি করতে হবে।’
এদিকে পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের দক্ষ করে তোলার জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘তাদের ভাষাগত, পরিবেশ, সংস্কৃতি বিষয়েও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া আমরা সব সময়ই কর্মীদের সতর্ক করি, যাতে দালালদের মাধ্যমে বিদেশে গমন না করেন।’
উল্লেখ্য, বিশ্বের ১৬৮টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির চুক্তি রয়েছে। এসব দেশে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম