Sunday 20 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘স্কুল ড্রেস পরা মেয়ে দেখলেই বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে’

আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৩ ডিসেম্বর ২০২১ ২২:৪১ | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২১ ১১:৪৫
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকা: দেখতে দেখতে তিনটা বছর কেটে গেল। হাঁটতে গেলে ওর কথা মনে পড়ে। চলতে গেলে ওর কথা মনে পড়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে যখনই স্কুলড্রেস পরা কোনো মেয়েকে যেতে দেখি, বুকের ভেতরে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। বুকটা হু হু করে ওঠে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না। আপনাআপনি চোখে পানি চলে আসে।

বলতে বলতেই যেন চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল বিউটি অধিকারীর। তিন বছর আগে মেয়ে অরিত্রী অধিকারীকে হারিয়েছেন তিনি। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের তখনকার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী ২০১৮ সালের এই দিনেই (৩ ডিসেম্বর) আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল তার নিজের ও মা-বাবার সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের রূঢ় আচরণ মেনে নিতে না পেরে। সারাবাংলার কাছে মেয়েকে নিয়েই স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

পরিবারের অভিযোগ, স্কুল কর্তৃপক্ষের অমানবিক আচরণেই অরিত্রী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলাও হয়েছিল। তিন বছরেও বিচার শেষ করা যায়নি সেই মামলার। এর পেছনে অবশ্য করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিরও ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, দ্রুতই মামলাটির বিচারকাজ শেষ হবে।

আরও পড়ুন-

অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী সারাবাংলাকে বলেন, তিন বছর আগে মা-বাবার অপমান সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা আত্মহত্যা করে চলে গেল। সে তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। কিন্তু আমরা তো তাকে ছাড়া মোটেই ভালো থাকতে পারছি না।

অরিত্রীকে হারানোর দিনের স্মৃতি এখনো মনে করে কাঁদেন দিলীপ অধিকারী। বলেন, শিক্ষকরা এমন দুর্ব্যবহার করেন, জানা ছিল না। তারা আমাদের কোনো কথা বলারই সুযোগ দিচ্ছিল না। শুধু বারবার বলছিল, কোনো কিছু শুনব না। কাল এসে মেয়ের টিসি নিয়ে যাবেন। সেই কথাটা এখনো কানে বাজে। সেদিন যদি তারা আমাদের আলাদা ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলতেন, তাহলে হয়তো মেয়েটাকে আমার হারাতে হতো না। তার সঙ্গে যারা খারাপ ব্যবহার করেছে, অন্যায় আচরণ করেছে, যার জন্য ওকে পৃথিবী ছেড়ে অকালে চলে যেতে হয়েছে, তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়। এ জন্যই লড়ে যাব।

বর্তমানে অরিত্রীর আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলাটি ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলমের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ২০১৯ সালের ১০ জুলাই এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু এর দুই বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ছয় জনের সাক্ষ্য নেওয়া গেছে। মামলাটিতে সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৪ জানুয়ারি।

মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাবিনা আক্তার (দিপা) সারাবাংলাকে বলেন, এটি একটি আলোচিত মামলা। মা-বাবাকে শিক্ষকেরা অপমান করছিলেন। সেই অপমান সইতে না পেরে অরিত্রীকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অরিত্রীর মা-বাব মেয়েকে হারিয়েছেন। যার সন্তান যায়, কষ্টটা তিনিই বুঝতে পারেন। আমরা তাদের ন্যায় বিচার দিতে মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করার জন্য তৎপর রয়েছি।

তিনি বলেন, মামলাটিতে ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন আদালত। পর্যায়ক্রমে সাক্ষী এনে মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত এগিয়ে নেব। মামলাটির বিচার যেন দ্রুত শেষ হয় এবং ভুক্তভোগীরা যেন ন্যায় বিচার পান, এজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।

অরিত্রীর আত্মহত্যার পরদিন ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর পল্টন থানায় বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছিলেন তার বাবা দিলীপ অধিকারী। মামলাটি তদন্ত করে ২০২০ সালের ২০ মার্চ ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিন্নাত আরাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট বা অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ। তারা দু’জনেই এখন জামিন রয়েছেন।

অভিযুক্ত এই দুই শিক্ষকের আইনজীবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন সারাবাংলার এই প্রতিবেদক। তবে তারা মামলাটি নিয়ে এখন কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়েছেন।

মামলায় শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকেও আসামি করা হয়েছিল। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কাজী কামরুল ইসলাম তাকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেছিল। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে বাকি দুই জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান শিক্ষক। মোবাইল ফোনে নকল করেছে— এমন অভিযোগে অরিত্রীর মা-বাবাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। দিলীপ অধিকারী তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলে উপাধ্যক্ষ তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। অধ্যক্ষের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এ সময় অরিত্রী দ্রুত অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়।

পরে অরিত্রীর মা-বাবা বিউটি অধিকারী ও দিলীপ অধিকারী তাদের শান্তিনগরে বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, অরিত্রী তার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্কুল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় স্কুলের অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষককে বরখাস্তও করে।

অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারী বলেন, মেয়েকে তো আর পাব না— এটা সত্য হলেও মেনে নিতে পারি না। তিন বছরে একটি দিনের জন্যও মেয়েকে ভুলে থাকতে পারিনি, ভুলে থাকা সম্ভব না। তবু যদি দোষীদের সাজা হয়, তাহলে হয়তো মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে। সেটুকুই প্রত্যাশা। আর চাই— আর কাউকে যেন অরিত্রীর মতো ভাগ্য বরণ করতে না হয়।

সারাবাংলা/এআই/টিআর

অরিত্রী অধিকারী অরিত্রী আত্মহত্যা মামলা অরিত্রীর আত্মহত্যা আত্মহত্যায় প্ররোচনা ভিকারুননিসা শিক্ষার্থী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর