হারিয়ে যাচ্ছে টিয়া
৪ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:৫৭
মৌলভীবাজার: টিয়া আমাদের দেশে অতিপরিচিত ও সুদর্শন একটি পাখি। প্রকৃতি ছাড়াও বাংলা সাহিত্য, আদি গল্প-কাহিনী ও পালাগানে রয়েছে টিয়া পাখির সরব উপস্থিতি। এক সময় মানিকগঞ্জের গ্রামে-গঞ্জে বিশেষ করে বনে অবাধে ঘুরে বেড়াত টিয়াসহ বহু প্রজাতির পাখি। কিন্তু গত এক দশক সময় ব্যবধানে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না প্রকৃতির অলংকারখ্যাত টিয়ার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন-জঙ্গল উজাড় এবং গাছপালা কেটে বসতি গড়ার কারণে বিলীন হয়ে যাচ্ছে পাখিদের অভয়ারণ্য।
গাঢ় রঙের আভিজাত্য, সুন্দর চলন-বলন, সহজেই পোষ মানা এবং বাকপটুতার কারণেই মানুষের কাছে অতি জনপ্রিয় এই পাখিটি। আমাদের দেশে সাধারণত সাত প্রজাতির টিয়া পাখির বসবাস। এগুলো হলো- চন্দনা টিয়া, বাসন্তী লটকন টিয়া, মদন টিয়া, লালমাথা টিয়া, মেটেমাথা টিয়া, ফুলমাথা টিয়া ও সবুজ টিয়া। এরা সাধারণত বন, বৃক্ষবহুল এলাকা, প্রশস্ত পাতার বন, আর্দ্র পাতাঝরা বন, খোলা বন, পাহাড়ি বন, বসতবাড়ির বৃহৎ বৃক্ষ, আবাদি জমি এবং পুরোনো বাড়িতে বসবাস ও বিচরণ করে।
টিয়া পাখির মোট প্রজাতি ৭টির মধ্যে সবুজ টিয়ার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে। সবুজ টিয়া কলাপাতা-সবুজ রঙের সুদর্শন পাখি। যাদের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৪২ সেন্টিমিটার, ওজন ১৩০ গ্রাম। সামান্য কিছু পালক ছাড়া পুরো দেহই সবুজ। দীর্ঘ সবুজ লেজের নিচের দিকে নীলের আমেজ পাখিটাকে আরও সৌন্দর্যময় করে তুলেছে। ঠোঁট মিষ্টি লাল, চোখ হলদে-সাদা। ছেলেপাখির থুতনিতে কালো রেখা, গলা ও ঘাড়ের পেছনে গোলাপি পাটল বর্ণ। আর মেয়েপাখির ঘাড় পান্না সবুজে ঘেরা। সবুজ টিয়া সচরাচর ছোট দলে থাকে, তবে জোড়ায়ও দেখা যায়। খাদ্য তালিকায় আছে- পত্রগুচ্ছ, ফুল, ফল, লতাপাতা, বীজ ও ফলের মিষ্টি রস। গ্রামের ধান ক্ষেতে সবুজ টিয়ারা নামে পাকা ধান খেতে। নদীর ধার দিয়ে শেষ বিকেল ও গোধূলিলগ্নে দল বেঁধে উড়ন্ত টিয়াদের দৃশ্য এক মনোরম মনকাড়া সৌর্ন্দের প্রতিচ্ছবি।
টিয়া (Parrot)। এটি Psittaciformes বর্গের পাখি। ইংরেজি নাম Rose-ringed Parakeet। বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula krameri। পরিবেশবাদী সংস্থা বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনালের এক সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এশিয়ার দেশুগলোতে পাখি শিকারের প্রবণতা মারাত্মক। ফলে ৬২ ভাগ পাখি বিলুপ্ত হয়েছে শিকারিদের হাতে। গবেষকদের মতে, শুধু শিকারিদের লোলুপদৃষ্টিই পাখি ধ্বংসের একমাত্র কারণ নয়। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়াও এর অন্যতম কারণ।
জানুয়ারি থেকে এপ্রিল হলো টিয়া পাখির প্রজননের সময়। বাসা বাঁধে গাছের প্রাকৃতিক কোটরে। এই পাখি বছরে ২ থেকে ৪টি ডিম দেয়। আর ডিম ফোটতে সময় লাগে ২২ থেকে ২৪ দিন। একটি শাবক টিয়া স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য সময় নেয় ৫০ থেকে ৫৫ দিন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান সারাবাংলাকে জানান, দেশের ঝোপঝাড় এবং পাখিদের খাদ্যের যোগান দেওয়া গাছগুলো দ্রুত কমতে থাকায় সবুজ টিয়া পাখিসহ সাত প্রজাতির টিয়ার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। পরিবেশ ও প্রকৃতির কথা চিন্তা না করে দিন দিন যে হারে বন-জঙ্গল উজাড় করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের হিড়িক পড়েছে তাতে করে শুধু টিয়াই নয়, বন্যপ্রাণী থেকে শুরু করে প্রায় সব প্রজাতির পাখিদেরই তীব্র খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দিন দিন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণী ও পাখি।
তিনি আরও বলেন, এসব পাখি এবং বন্যপ্রাণীদের টিকিয়ে রাখতে হলে বনভূমি বাড়াতে হবে এবং একইসঙ্গে বৃক্ষ উজাড় বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় এক সময় প্রায় সব প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তরুণ সমাজকে একজোট হয়ে কাজ করার জন্যও আহ্বান জানান তিনি।
বন্যপ্রাণী ও পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল তৈরির পাশাপাশি চোরা শিকারিদের তৎপরতা বন্ধ করতে না পারলে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রকৃতি থেকে এসব বন্যপ্রাণী বিভিন্ন প্রজাতির পাখির পাশাপাশি প্রকৃতির শোভা টিয়া পাখির নামটিও খুব দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই টিয়া পাখি রক্ষায় সকলের সজাগ দৃষ্টি ও আন্তরিকতার খুব বেশি প্রয়োজন বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।
সারাবাংলা/এনএস