চট্টগ্রামে এবার খালে তলিয়ে গেল শিশু
৭ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:০৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে বৃষ্টির মধ্যে এবার এক শিশু খালে তলিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে উদ্ধার অভিযানে নেমেছে ফায়ার সার্ভিস। খালে ও সংলগ্ন নালায় রাতভর একাই ছেলের খোঁজ করেছেন শিশুটির বাবা। পরে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সংবাদ পৌঁছার পর তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে তল্লাশি শুরু করে।
ওই শিশুর সঙ্গে সমবয়সী তার বন্ধুও বোতল কুড়াতে খালে নেমেছিল। বন্ধু উঠে আসতে পারলেও শিশুটি খাল ও নালায় আটকে থাকা ময়লার স্তূপের ভেতরে তলিয়ে যায় বলে জানা গেছে।
সোমবার (৬ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর রেলস্টেশনের প্রবেশমুখে চশমা খালে এ ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নিখোঁজ শিশুটির নাম মো. কামাল উদ্দিন (১০)। তার বাবা আলী কাউসার জানিয়েছেন, নগরীর দেওয়ান বাজার মাছুয়া ঝর্ণা এলাকায় তাদের বাসা। তবে তারা বসবাস করেন ষোলশহরে একটি কলোনিতে।
আরও পড়ুন-
চট্টগ্রামে নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিখোঁজ
চট্টগ্রামে জলজটে ভোগান্তি, নালায় পড়ে নিখোঁজ বৃদ্ধ
২৪ ঘণ্টা পরও মেলেনি খোঁজ, বাবার ‘লাশের’ অপেক্ষায় ছেলে
এক টন আবর্জনা সরিয়ে ৭০ ফুট গভীর থেকে ছাত্রীর লাশ উদ্ধার
নগরীর শুলকবহর এলাকায় কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক) নামে একটি বেসরকারি সংস্থা ভাসমান শিশুদের জন্য দুপুরে একবেলা আহার ও একঘণ্টা হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দেয়। নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে ভাসমানভাবে থাকা কামাল ও তার বন্ধু রাকিব কোডেকের ওই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিত।
রাকিব সারাবাংলাকে জানায়, সোমবার বিকেল ৪টার দিকে তারা চশমা খালে বোতল কুড়াতে নেমেছিল। এসময় বৃষ্টিপাত হচ্ছিল এবং খালে পানি বেশি ছিল। ষোলশহর দুই নম্বর গেইট থেকে দক্ষিণ দিকে চশমা খালে সাঁতার কেটে যাওয়ার সময় তারা ফোম জাতীয় একটি বস্তু পায়। সেটি নিয়ে খেলতে খেলতে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল। রেলস্টেশনের কাছে যেখানে খালের সঙ্গে নালা মিশেছে, সেখানে স্রোত বেশি ছিল। স্রোতের টানে কামাল তলিয়ে যায়। লোহার একটি খুঁটির সঙ্গে আটকে যাওয়ায় রাকিব উঠে আসতে সক্ষম হয়। তবে কামাল তলিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ভয়ে শুরুতে সে কাউকে জানায়নি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ওই এলাকায় কামালের বাবা আলী কাউসারকে দেখে ঘটনা জানায়।
‘ভবঘুরে’ আচরণের আলী কাউসার সারাবাংলাকে বলেন, ‘যখন আমি শুনি যে আমার ছেলে নালায় পড়ে গেছে, তখন আমি নালায় নামি। একটি কাঠের টুকরা দিয়ে ময়লা সরিয়ে খুঁজতে থাকি। কিন্তু এত বেশি ময়লা, আমি নালার ভেতর দিকে যেতে পারিনি। তারপরও সারারাত আমি রাস্তা থেকে নালার মধ্যে ময়লার ভেতরে যতটা পারি খুঁজেছি যে আমার বাবাটা আছে কি না।’
কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘অনেক খুঁজেছি, আমার বাবাটাকে পাইনি। ময়লা এত বেশি, আমার বাবাটাকে আমি পাইনি।’
উল্লেখ্য, নগরীর চশমাখালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ চলছে। ষোলশহর রেলস্টেশনের আগে ভূমি অফিসের পেছনে খালে একটি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ওই বাঁধের কারণে সেখানে পানি আটকে থাকে। সোমবার দিনভর টানা বৃষ্টির কারণে সেখানে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয়। ওই বাঁধের সঙ্গে লাগোয়া একটি নালা আছে। নালাটি ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ধারণা, বাঁধের কাছে এসে স্রোতের মধ্যে পড়ে কামাল নালায় ময়লার ভেতরে তলিয়ে গেছে।
কামালের বাবা আলী কাউসারের অভিযোগ, স্থানীয় পাঁচলাইশ থানার টহল টিমের এক সদস্যকে তিনি ছেলে নিখোঁজের ঘটনাটি বলেছিলেন। ওই পুলিশ সদস্য তাকে উত্তর দেন— তোর ছেলে, তুই নিজে খোঁজ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমিও শুনেছি বিষয়টি। তবে কোন পুলিশ সদস্যকে তিনি এ বিষয়ে জানিয়েছিলেন বা আদৌ জানিয়েছিলেন কি না, সেটি তো আমরা পাইনি। যদি থানায় খবর দেওয়া হতো, সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নিতাম। আজ (মঙ্গলবার) খবর পেয়েই পুলিশের টিম পাঠানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের টিমও ঘটনাস্থলে আছে।’
এদিকে নিখোঁজের প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বিষয়টি জানতে পারে চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। কোডেকের কর্মকর্তা সামি হোসেন মোহন বিষয়টি জানানোর পর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে।
আরও পড়ুন-
- জলজট ও প্রাণহানি: খালে সিডিএর বাঁধকে দূষছে চসিক
- নাবিকের অসতর্কতায় জাহাজ ডুবলে সে দোষ সমুদ্রের নয়
- নালায় পড়ে নিখোঁজের দায় সিডিএর, চসিকও ‘দায়মুক্ত নয়’
- নালায় পড়ে ছাত্রীর মৃত্যু: সিডিএর ঘাড়ে দায় চাপালেন মেয়র
- খোঁজ মেলেনি ৩ দিনেও, নালায় আবর্জনায় আটকে থাকার ধারণা
- চট্টগ্রামে ড্রেনে পড়ে মৃত্যু: ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে নোটিশ
কোডেকের সেন্টার প্রজেক্টর সামি হোসেন মোহন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন দুপুরে কামাল-রাকিবসহ ষোলশহর রেলস্টেশনে ভাসমানভাবে থাকা ৬০টি শিশু আমাদের সেন্টারে ভাত খায়। তাদের আমরা প্রতিদিনি এক ঘণ্টা করে বৈদ্যুতিক কাজের প্রশিক্ষণ দিই। আজ (মঙ্গলবার) দুপুরে কামাল ও রাকিবকে না দেখে আমি তাদের খোঁজ নিই। স্টেশনে এসে রাকিবকে খুঁজে বের করার পর সে জানায়, কামাল বোতল কুড়াতে গিয়ে খালে পড়ে গেছে। পরে নালায় ময়লা-আবর্জনার ভেতরে সে তলিয়ে গেছে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিই। এখানে রাস্তার পাশে খাল-নালা। কিন্তু কোনো স্ল্যাব নেই। আমি জানি না, শিশুটির ভাগ্যে কী আছে!’
ঘটনাস্থলে থাকা বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের অফিসার মো. তানভির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলে এসেই উদ্ধারকাজ শুরু করেছি। তবে ময়লা-আবর্জনায় ভরা নালা ও খাল। এজন্য উদ্ধার অভিযানে সমস্যা হচ্ছে। আমাদের ডুবুরি দলও এসেছে।’
এর আগে, গত ২৫ আগস্ট সকালে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে নগরীর মুরাদপুরে সড়ক ও ফুটপাতের সঙ্গে লাগোয়া একটি নালায় পড়ে নিখোঁজ হন প্রায় ৫৫ বছর বয়সী সালেহ আহমদ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, আটকে থাকা বৃষ্টির পানিতে নালা ও ফুটপাত ছিল একাকার। নালার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পা পিছলে পড়ে যান তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই প্রবল স্রোতে ভেসে যান পেশায় সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমদ। ঘটনার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও তার খোঁজ মেলেনি।
ওই ঘটনার একমাস পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে নগরীর ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কে জেক্স মার্কেটের সামনে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া (১৯) নামে এক তরুণী। ফায়ার সার্ভিস তল্লাশি চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৭০ ফুট দূরে নালার ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। সেহেরীন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।
উভয় ঘটনার পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা একে অন্যকে দায়ী করে বক্তব্য দেয়।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর