Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আমার বাবাটার লাশ যেন পাই’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৮ ডিসেম্বর ২০২১ ১৮:০০

চট্টগ্রাম ব্যুরো: নিখোঁজের ৪৮ ঘণ্টা পরও চট্টগ্রাম নগরীতে খালে তলিয়ে যাওয়া শিশুর খোঁজ মেলেনি। শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য তল্লাশি চালাতে গিয়ে ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনের কর্মীরা কয়েক টন ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করেছে। তবে খাল এবং এর সংলগ্ন নালায় ময়লা-আবর্জনার পরিমাণ বেশি থাকায় তল্লাশিতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানিয়েছেন।

সন্তানকে ফিরে পাবার আশায় খালের পাড়েই দিন কাটছে বাবা আলী কাউসারের। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সিটি করপোরেশনের কর্মী, সাংবাদিকদের কাছে এসে বারবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে সন্তানকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন। আলী কাউসার বলেন, ‘জীবিত ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেটা বুঝতে পারছি। আমার বাবার লাশটা যেন অন্তত পাই।’

বিজ্ঞাপন

সোমবার (৬ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নগরীর ষোলশহর এলাকায় চশমা হিলে পানির স্রোতে তলিয়ে যায় ১০ বছর বয়সী শিশু মো. কামাল উদ্দিন। ভবঘুরে আচরণের আলী কাউসারের ছেলে কামাল ষোলশহর রেলস্টেশনে ভাসমানভাবে থাকতো। সোমবার সন্ধ্যায় আলী কাউসার ঘটনা জেনে নিজেই খালে ও সংলগ্ন নালায় ময়লা-আবর্জনার ভেতর খোঁজাখুঁজি করেন। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরাও।

মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তল্লাশি শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের দু’টি ইউনিটের সদস্যরা। এরপর ডুবুরি দলের সদস্যরাও যোগ দেন। রাত ১১টা পর্যন্ত কাজের পর বুধবার সকাল থেকে আবারও তল্লাশি শুরু হয়। বুধবার (৮ ডিসেম্বর) থেকে সিটি করপোরেশনের কর্মীরাও খাল-নালা থেকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণে যোগ দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক নিউটন দাশ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, ষোল শহরে চশমা খালের যে পয়েন্টে শিশুটি নিখোঁজ হয়েছে বলে তাদের জানানো হয়েছে, সেই পয়েন্ট থেকেই তল্লাশি শুরু হয়। সেখানে খালের সঙ্গে নালা আছে। ষোলশহর রেলস্টেশনের আশপাশ থেকে চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সের পেছনে পর্যন্ত নালায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে।

ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর সামশুল আলম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল এবং আশপাশের নালা থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ টনের ময়লা-আবর্জনা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে প্লাস্টিকের বোতল, ককশিট ও পলিথিন। খাল থেকে ময়লা উত্তোলনে তেমন সমস্যা না হলে নালায় বেগ পেতে হচ্ছে। নালার ভেতরে ঢুকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণে সময়ও বেশি লাগছে।

তবে নিখোঁজ শিশুটি আদৌ সেখানে কোথাও ময়লা-আবর্জনার ভেতরে আটকে আছে কি না, সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘শিশুটি এখানে আটকে আছে নাকি পানিতে তলিয়ে আরও দূরে চলে গেছে সেটি বলা খুব মুশকিল। ড্রেনে এত বেশি ময়লা যে, সেগুলো অপসারণ করতে গিয়ে আমাদের খুব বেগ পেতে হচ্ছে। ড্রেনে শুধু পানি থাকলে সেটা বলা সহজ হতো।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ষোলশহরে চশমাখালে চলমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় বাঁধ দেওয়া হয়েছে। সেখানে একটা ক্রস কালভার্টও আছে। এজন্য ময়লা-আবর্জনা সহজে যেতে না পেরে সেগুলো আটকে গেছে। তবে স্কেভেটর দিয়ে চশমাখাল থেকে ময়লা প্রায় তুলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ড্রেনের ভেতরে ময়লা বেশি। সেখানে পানি কম, মাত্র দুই থেকে আড়াই ফুট হতে পারে। আমাদের মেয়র মহোদয় গতকাল (মঙ্গলবার) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে কাজ করছি।’

শিশুটির বাবা আলী কাউসার খালের পাড়ে বসে আছেন রাতদিন। মাঝে মাঝে চোখের পানি মোছেন। স্কেভেটরের আগায় ময়লার স্তূপ দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন, বারবার দেখছেন ময়লার সঙ্গে তার ছেলেটি উঠে আসল কি না।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আলী কাউসার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ময়লা খুব বেশি। ময়লার জন্যই আমার ছেলেটা নালা থেকে উঠতে পারেনি। আমি নিজে নেমে ময়লার ভেতর খুঁজেছি। নালার ভেতরে এত ময়লা, সেখানে ঢোকা যাচ্ছে না। আমার বাবাটাকে যেন পাই, আর কিছু চাই না। হয়তো জীবিত আর পাব না, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু বাবার লাশটা যেন অন্তত পাই !’

কামালের বন্ধু রাকিবের ভাষ্য অনুযায়ী, সোমবার বিকেল ৪টার দিকে তারা চশমা খালে বোতল কুড়াতে নেমেছিল। এ সময় বৃষ্টি হচ্ছিল এবং খালে পানি বেশি ছিল। ষোলশহর দুই নম্বর গেইট থেকে দক্ষিণ দিকে চশমা খালে সাঁতার কেটে যাবার সময় তারা ফোম জাতীয় একটি বস্তু পায়। সেটা নিয়ে খেলতে খেলতে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল। রেলস্টেশনের কাছে যেখানে খালের সঙ্গে নালা মিশেছে, সেখানে স্রোত বেশি ছিল। স্রোতের টানে কামাল তলিয়ে যায়। লোহার একটি খুঁটির সঙ্গে আটকে যাওয়ায় রাকিব উঠে আসতে সক্ষম হয়।

তবে কামাল তলিয়ে যাবার বিষয়টি ভয়ে শুরুতে সে কাউকে জানায়নি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ওই এলাকায় কামালের বাবা আলী কাউসারকে দেখে ঘটনা জানায়। আলী কাউসার রাত পর্যন্ত নিজে নিজে খালে ও সংলগ্ন নালায় খোঁজাখুঁজি করেন। কামাল ও রাকিবকে ইলেকট্রিক্যাল কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া এনজিও কোডেকের এক কর্মকর্তা ঘটনা জানতে পেরে পরদিন ফায়ার সার্ভিসকে জানায়। এরপর বিষয়টি জানাজানি হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম নগরীতে একই ধরনের আরও দু’টি ঘটনা নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। গত ২৫ আগস্ট সকালে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে নগরীর মুরাদপুরে সড়ক ও ফুটপাতের সঙ্গে লাগোয়া একটি নালায় পড়ে নিখোঁজ হন প্রায় ৫৫ বছর বয়সী সালেহ আহমদ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, আটকে থাকা বৃষ্টির পানিতে নালা ও ফুটপাত একাকার হয়ে যায়। নালার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পা পিছলে পড়ে যান তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই প্রবল স্রোতে ভেসে যান পেশায় সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমদ। ঘটনার তিনমাস পেরিয়ে গেলেও তার খোঁজ মেলেনি।

ওই ঘটনার একমাস পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে নগরীর ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কে জেক্স মার্কেটের সামনে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া (১৯) নামে এক তরুণী। ফায়ার সার্ভিস তল্লাশি চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৭০ ফুট দূরে নালার ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। সেহেরীন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

উভয় ঘটনার পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা একে অন্যকে দায়ী করে বক্তব্য দেন।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

চট্টগ্রাম টপ নিউজ নালা শিশু

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ইনজুরিতে মৌসুম শেষ রদ্রির
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:২৮

সম্পর্কিত খবর