মাসে চাঁদা দেড় কোটি, সম্পদের পাহাড়— অভিযুক্ত সড়ক নেতা এনায়েত
৯ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:৩৫
ঢাকা: এনা পরিবহন। দেশের পরিবহন খাতে এক নামে পরিচিত। ১৯৮৪ সালে একটিমাত্র বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহত্তম পরিবহন কোম্পানি। দেশের প্রায় সব রুটেই এখন দেখা মেলে এই পরিবহনটির। আর এই এনা পরিবহনেরই মালিক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব। এনা পরিবহনের মতো তিনিও দেশব্যাপী এক সুপরিচিত নাম। এনা পরিবহন যেমন দেশের অন্যতম বড় পরিবহন কোম্পানি, এনায়েত উল্যাহও তেমনি এই খাতের অন্যতম প্রভাবশালী এক ব্যক্তিত্ব।
অভিযোগ উঠেছে, পরিবহন খাতের এই নেতা একপর্যায়ে সরকারি দলের প্রভাব বলয়ে ঢুকে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। তার নেতৃত্বে এখন প্রতি মাসে চাঁদা ওঠে প্রায় এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর বেশিরভাগই যায় এনায়েতের পকেটে। চাঁদাবাজির টাকাতেই বেশিরভাগ গাড়িরও মালিক হয়েছেন। এর মধ্যেই নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। সেসব নিয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। সে অভিযোগ আমলে নিয়ে এনায়েত উল্যাহর বিরুদ্ধে দুদক তদন্তও শুরু করেছে।
পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১৯৮৪ সালে মিরপুর-গুলিস্তান রুটে একটি বাস দিয়ে এনা পরিবহনের যাত্রা শুরু। ২০১৩ সালেও এই কোম্পানিতে বাসের সংখ্যা ছিল ৫০টির মতো। আট বছর পর এসে এর বহরে বাসের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াইশতে। ঢাকার বাইরে একটা সময় পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে একচেটিয়া ব্যবসা করা এনা পরিবহন এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রায় সব রুটে। হুন্দাই, স্ক্যানিয়া, ভলভোর মতো অত্যাধুনিক সব বাস রয়েছে পরিবহনটিতে।
২০১৩ সালের পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি শুরু হয়। ওই সময়টিতে সড়কে চলাচলকারী বিপুল পরিমাণ গণপরিবহনে আগুন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে প্রায় একশ কোটি টাকা বরাদ্দ দেন। অভিযোগ আছে, সেই বরাদ্দের টাকা বিতরণের অন্যতম মূল দায়িত্বে থাকা এনায়েত উল্যাহ এর বড় একটি অংশ নিজেই আত্মসাৎ করেন। ওই সময় থেকেই চাঁদাবাজির নেতৃত্বেও চলে আসেন তিনি।
পরিবহন জগতের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ১৯৮৪ সালে ঢাকার মিরপুর-গুলিস্তান রুটে একটি বাস দিয়ে পরিবহন ব্যবসায় নাম লেখান এনায়েত উল্যাহ। ওই সময় মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন তিনি। সংগঠনের প্রভাবে এনা পরিবহনের ব্যবসা বাড়তে থাকে। তবে ২০১৩-১৪ সালের দিকে জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির সময় এনা পরিবহনের বেশকিছু বাস পুড়ে গেলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের নজরে পড়েন এনায়েত। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গত ২৫ নভেম্বরের সবশেষ কাউন্সিলেও তিনি দুই বছরের জন্য সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় মহাসচিবের পদ পেয়েছেন। এর মধ্যে গত বছর পেয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ।
আরও পড়ুন- এনায়েত উল্যাহর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে: বাস মালিক সমিতি
ক্রমেই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা এনায়েত উল্যাহর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, সরকার দলীয় পদ বাগিয়ে নেওয়া, বার বার পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব হওয়ার মাধ্যমেই ক্ষমতাধর হয়েছেন এনায়েত। এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক। নামে-বেনামে এবং স্ত্রী-সন্তান-আত্মীয়-স্বজনদের নামে গড়েছেন একের পর এক সম্পদ। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও সিলেটে রয়েছে বাহারি সব বাড়ি ও বাংলো।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, খন্দকার এনায়েত উল্যাহর তত্ত্বাবধানে বর্তমানে পরিবহন খাত থেকে প্রতি মাসে প্রায় এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এর বেশিরভাগই যায় এনায়েতের পকেটে। আর সেই টাকাতেই বাড়ছে এনা পরিবহনের বহর।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, এনায়েতের বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। চাঁদাবাজিসহ অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন রয়েছে এসব অভিযোগের মধ্যে। এরই মধ্যে গত ১৪ জুন সম্পদের হিসাব চেয়ে এনায়েত উল্যাহকে নোটিশও দিয়েছে দুদক। নোটিশ পেয়ে সম্পদের হিসাবও জমা দিয়েছেন এনায়েত উল্যাহ।
এর মধ্যে সবশেষ গত ২৫ অক্টোবর খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ও তার পোষ্যদের সম্পদের নথিপত্র চেয়ে সরকারি-বেসরকারি ৫৮টি ব্যাংকসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। ব্যাংকগুলোর বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ৩০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিআরটিএ, নিবন্ধন অধিদফতর, জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর, ডাক বিভাগ, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ পাঁচ সিটি করপোরেশন, ময়মনসিংহ ও কক্সবাজার পৌরসভা এবং জাতীয় গৃহায়ন অধিদফতরও। এসব প্রতিষ্ঠানে দেওয়া চিঠিতে এনায়েত উল্যাহ, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের নামে থাকা হিসাবের বিবরণীসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র চাওয়া হয়েছে।
এনায়েত উল্যাহ নিজে অবশ্য তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগই অস্বীকার করছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে পরিবহন ব্যবসা করছি। বর্তমানে আমার কোম্পানিতে ২৫০টির মতো বাস রয়েছে। কিন্তু এই একই সময়ে অন্য আরও অনেক কোম্পানির বাসের সংখ্যা এর চেয়েও বেশি বেড়েছে। বেশ কয়েকটি শীর্ষ কোম্পানির মধ্যে আমার কোম্পানি একটি। আমি ব্যাংক লোন করেছি, প্রতি বছর লাভের টাকা বেড়েছে। একাধিক বাসের লাভের টাকা দিয়ে আরও গাড়ি কিনেছি। এভাবে বাসের সংখ্যা বেড়েছে। সম্পদও বেড়েছে। আমার যা কিছু আছে, তার বিপরীতে নিয়মিত আয়করও দেওয়া হয়েছে।
প্রণোদনার টাকা আত্মসাৎ ও চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে এনায়েতের মন্তব্য, এগুলো প্রতিপক্ষের বানোয়াট অভিযোগ। তিনি বলেন, প্রতিদিন যে চাঁদা ওঠানোর অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। আদৌ এর সত্যতা নেই। ব্যবসা করতে গেলে প্রতিপক্ষ তৈরি হয়। সেই প্রতিপক্ষ গ্রুপটিই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। দীর্ঘদিন ধরে আমি এই খাতে রয়েছি। সুশৃঙ্খলভাবে এই খাতটি কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা সবাই দেখছেন। একটি পক্ষ হয়তো এই খাতকে অস্থিতিশীল করতে চায়। সেই চক্রটিই হয়তো আমাকে হটিয়ে এখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের পাঁয়তারা করছে।
দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এনায়েত উল্যাহ বলেন, একটি সাংবিধানিক ও স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দুদক যে কারও কাছে সম্পদের হিসাব চাইতে পারে। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখেছি এবং এরই মধ্যে আমার সম্পদের হিসাব দুদকে জমাও দিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে দুদকে যে অভিযোগটি জমা পড়েছে, সেটি সম্পূর্ণ ভুয়া। তদন্ত চলছে। এতে যদি আমি দোষী সাব্যস্ত হই, তাহলে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে দুদক। আর নির্দোষ হলে আমার কিছুই হবে না।
দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে জানতে চাইলে সাংবিধানিক সংস্থাটির উপপরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহাম্মদ আরিফ সাদেক সারাবাংলাকে বলেন, এনায়েত উল্যাহর বিরুদ্ধে আমরা কিছু অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। তার কাছেও কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। তিনি কিছু তথ্য দিয়েছেন। সেগুলো নিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে।
এনায়েত উল্যাহর দেওয়া তথ্যে বা অনুসন্ধানে কোনো ধরনের অসঙ্গতি পেয়েছেন কি না— জানতে চাইলে দুদক উপপরিচালক বলেন, অনুসন্ধান চলমান। এখনো এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। তদন্ত শেষ হলে আমরা গণমাধ্যমকে জানাব।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর
অবৈধ সম্পদ এনা পরিবহন এনায়েত উল্যাহ চাঁদাবাজি দুদক দুদকে অভিযোগ দুদকের অনুসন্ধান দুর্নীতি দমন কমিশন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি