পরামর্শক কমিটির অভিমত— এখনই বুস্টার ডোজ নয়
১০ ডিসেম্বর ২০২১ ১১:০৪
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য করোনা ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে এখনই এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তের দিকে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ভ্যাকসিন বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি। নাইট্যাগ (ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ) সদস্যসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ৮০ শতাংশ জনসংখ্যাকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ না করে বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত নয়। একইসঙ্গে বর্তমানে দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের বড় একটি অংশ এখন পর্যন্ত এক ডোজ ভ্যাকসিনই পাননি। এ অবস্থায় বুস্টার ডোজের সিদ্ধান্ত হবে বৈষম্যমূলক।
৩০ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন রোধে করণীয় নির্ধারণী আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। ওই সভা শেষে সাংবাদিকদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, আজ আমরা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি— ৬০ বছরের বেশি বয়স্কদের বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে বসে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা হয় ভ্যাকসিন বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির বৈঠকে। নাইট্যাগের সভাপতি অধ্যাপক ডা. চৌধুরী আলী কাওসার সারাবাংলাকে বলেন, অনেক দেশেই বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। এটিকে অনেকে থার্ড ডোজও বলা হয়। কিন্তু সেসব দেশগুলোতে ভ্যাকসিন কাভারেজ অনেক বেশি। অর্থাৎ দেশগুলোতে অনেক বেশি মানুষকে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমেরিকা ও চীনে বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে এখন। আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশে বুস্টার ডোজ দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সেটা দেওয়া হবে।
অধ্যাপক ডা. চৌধুরী আলী কাওসার আরও বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে— প্রাথমিক পর্যায়ে দুই ডোজ ভ্যাকসিন অনেককেই দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২২ থেকে ২৩ শতাংশকে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা, ডিসেম্বরের মধ্যে ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা।
বুস্টার ডোজের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন নাইট্যাগ সভাপতি। তিনি বলেন, আমরা এই ডিসেম্বরের মধ্যে ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে যেন ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে পারি, সেটি নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে হবে। সেটি করতে না পারলে যারা এখন পর্যন্ত এক ডোজ ভ্যাকসিনও পাননি, তাদের মধ্যে সংক্রমণ দেখা দিলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। সে কারণে আমরা মনে করছি, এখনই বুস্টার ডোজ জরুরি নয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে যারা মারা গেছেন তাদের বড় একটি অংশ বয়সে পঞ্চাশোর্ধ্ব। এই বয়সসীমার প্রায় ৭৬ শতাংশ মানুষ কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন। তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, এই বয়সসীমার মানুষদের যত দ্রুতসম্ভব দুই ডোজ ভ্যাকসিনের আওতায় আনা। সেটি না করে বুস্টার ডোজ দেওয়া হলে এরই মধ্যে যারা ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলেছেন, তাদেরই আরও শক্তিশালী করে তোলা হবে। অন্যদিকে যারা ভ্যাকসিনের এক ডোজও পাননি, তাদের ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হবে।
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে নাইট্যাগ আবার বৈঠকে বসবে। সেই বৈঠকে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে আলোচনা হবে বলে জানান অধ্যাপক ডা. চৌধুরী আলী কাওসার।
ভ্যাকসিন বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নির্দিষ্টসংখ্যক জনসংখ্যার সবাইকে ভ্যাকসিন কার্যক্রমের আওতায় আনা। যদি একজন মানুষও সেখানে ভ্যাকসিনের দুই ডোজ না পেয়ে থাকেন, তবে অন্যরাও কিন্তু সুরক্ষিত, এমনটা বলা যায় না।
তিনি বলেন, নাইট্যাগের একটি বৈঠকে বুস্টার ডোজ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যাদের আগে ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা, তাদের দুই ডোজ দেওয়া আগে নিশ্চিত করতে হবে— এমনটা আলোচনা হয়েছে। যারা এরই মধ্যে সুরক্ষিত, তাদের আবার বুস্টার ডোজ দেওয়াটা অনেকটা ডাবল বা ওভার সিকিউরিটি দেওয়ার মতো বিষয়। সেক্ষেত্রে যারা এক ডোজ ভ্যাকসিনও পাননি, তাদের ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া হবে। এ কারণেই মূলত আমরা এখনই বুস্টার ডোজ দিতে হবে— এমন কোনো মতামত দিইনি।
তিনি আরও বলেন, ওমিক্রন প্রতিরোধে অনেকে বুস্টার ডোজের বিষয়ে বলছেন। কিন্তু এই ওমিক্রনে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যু হয়নি। ওমিক্রনের সংক্রমণ মাত্রাও ডেল্টার চাইতে বেশি— এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই ওমিক্রনকে ঘিরে বুস্টার ডোজ তড়িঘড়ি করে দেওয়া অনেকটা খাপছাড়া পরিকল্পনা হয়ে যায়।
অধ্যাপক ডা. বেনজীর বলেন, সবদিক বিবেচনা নিয়ে আমরা বলেছি, এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে বুস্টার ডোজ দেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। প্রথমত, যাদের বয়স ৫৫ বছরের বেশি তাদের মাঝে যারা এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন নেননি, তাদেরই প্রথমে দুই ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এরপরে ক্রমান্বয়ে ৪০ বছর, ৩০ বছর ও অন্যান্য বয়সসীমার জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। এটা দ্রুত করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ওমিক্রনের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক ডেল্টা ও অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট। এগুলোর কারণে কিন্তু ইউরোপের দেশগুলোসহ অন্যান্য দেশে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এবং এসব ভ্যারিয়েন্টই মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। সেখান থেকে নিরাপদে থাকতে হলে আমাদের দুই ডোজ ভ্যাকসিনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে সবার মধ্যে। সেটা হয়ে গেলে তারপর বুস্টার ডোজের বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।
নাইট্যাগের পরামর্শ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মন্তব্য জানতে তার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশে বুস্টার ডোজ প্রয়োগ নিয়ে বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) বিকেলে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে জানান, সুরক্ষা অ্যাপ আপডেটসহ অন্যান্য কার্যক্রম শেষ হলে বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হবে— এমন আলোচনা হয়েছে। এজন্য বর্তমানে যেসব স্থানে ভ্যাকসিন প্রয়োগ হচ্ছে, সেখানেই আলাদা বুথ করে বুস্টার ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বুস্টার ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে দুই হাজার নার্সকেও। তবে কখন থেকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে বৈঠক সূত্রে।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োগ করা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়েছেন প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন ২৩ শতাংশ নাগরিক।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর