Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘দূতাবাস যদি কথা শুনতো তাহলেও কষ্ট কম হতো’

শেখ জাহিদুজ্জামান,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১১ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:২৭

বাংলাদেশ হাই কমিশন, ছবি: সারাবাংলা

মালদ্বীপ ঘুরে এসে: আরিফ হোসেন (ছদ্মনাম)। ৬ বছর আগে পরিবার ও জীবিকার টানে মালদ্বীপে পাড়ি জমান। কিন্তু দেশটিতে গিয়ে ভালো নেই তিনি। কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান যে বেতনের কথা বলে নিয়েছিল সেটা মাস শেষে দেয়নি। এ নিয়ে দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে গেলেও কোনো সমাধান পাননি।

মালদ্বীপের মালে শহরের হোলেমালেতে সারাবাংলাকে এসব তথ্য জানান আরিফ। তিনি বলেন, দূতাবাস যদি কথা শুনতো তাহলেও আমাদের কষ্ট অনেক কম হতো। দূতাবাস যদি প্রবাসীদের সহায়তা করত, তাহলে হাজারও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মালদ্বীপে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো না বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

কীভাবে মালদ্বীপে এলেন জানতে চাইলে আরিফ বলেন, তার চাচাতো ভাইয়ের মাধ্যমে মালদ্বীপে পাড়ি জমান। ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি আসেন। বাড়ির জমি এবং মায়ের গয়না বিক্রি করে আসেন। প্রথমে একটি কন্সট্রাকশনে কাজ করতেন। সেখানে প্রথম তার বেতন ধরা হয় প্রতিদিন মালদ্বীপের ৫০০ রুপিয়া। সেই হিসাবে মাসে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু ২৩ দিন কাজ করার পর সেই মাসের কোনো বেতনই তাকে দেওয়া হয়নি। এরপর একটি মাছের বোটে কাজ পান। সেখানে আরও কমে তার কাজ হয়। সেই টাকাও মাস শেষে অর্ধেক পান। এভাবে ৪-৫টি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মাস শেষে বেতন কম দেয়। কিন্তু বললে কাজ চলে যায়। এভাবে অনেক দিন দূতাবাসে গিয়েছেন অভিযোগ নিয়ে।

দূতাবাস অভিযোগ নিয়ে গেলে কী বলে— জানতে চাইলে বলেন, ‘আমাদের তো দূতাবাসে ঢুকতেই দেয় না। আমাদের কথাই তারা শোনে না। আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে, যেন আমরা মানুষ না। দূর দূর করে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয় সিকিউরিটি দিয়ে। এভাবে খুব কষ্টে আমাদের জীবন যায়। এরপর হোলেমালে শহরে একটি রেস্টুরেন্টে আমার কাজ হয়। বর্তমানে এখানেই কাজ করছি। বেতন ঠিকঠাক এখন পেলেও খুব কম বেতনে কাজ করছি। কিন্তু কি আর করা। পরিবারের সবকিছু বিক্রি করে বিদেশে আসছি। এখন বাড়িতে ফিরে যাওয়ারও আর কোনো উপায় নেই।’

বিজ্ঞাপন

বাড়িতে কে কে আছে জানতে চাইলে আরিফ বলেন, ‘মা-বাবা আর ছোট বোন। ছোট বোনটা পড়ালেখা করে। বাবা আর মা কিছুই করতে পারে না। আমার টাকায় তাদের সবকিছু হয়। বিদেশে যত কষ্টই হোক যখন পরিবারের কথা মনে পড়ে তখন সব কষ্ট ভুলে যাই। আমি চাই বাড়ির সবাই ভালো থাকুক। কখনো কাউকে এভাবে নিজের জীবনের কথা বলা হয়নি। এমনও দিন গেছে এক বেলা খেতে পারিনি।’

করোনার সময় দিনগুলো কেমন ছিল— প্রশ্ন করতে আরিফ বলেন, ‘খুব কষ্টের ছিল। হোলেমালে শহরে তখন কোনো মানুষ নেই। রেস্টুরেন্ট বন্ধ। দিনে এক বেলা খাবার পেতাম, তাও খুব কম। তখন কোনো বেতন ছিল না। দূতবাস থেকে কিছু সহায়তা তখন দেওয়া হয়। কিন্তু মাসের পর মাস তারা সহায়তা করেনি। করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে যখন পর্যটকরা আসা শুরু করে তখন আমাদের বেতন দেয় অর্ধেক করে। এখন পরিস্থিতি একটু ভালো। বেতন পুরোটা দেয়। কিন্তু করোনার সময় অনেক প্রবাসাী বাংলাদেশি দেশে চলে গিয়েছে। তারা আর আসতে পারেনি।

আগামী দিনের নিজের স্বপ্নের বিষয়ে আরিফ বলেন, আমার স্বপ্ন একটাই পরিবার যেন ভালো থাকে। মালদ্বীপে আরও কয়েক বছর থাকতে চাই। এরপর দেশে যাব। একটা ব্যবসা করব। পরিবার নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করব। কিন্তু আমরা যারা প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছি, তাদের কথা যদি দূতাবাস একটু হলেও শুনতো আমাদের কষ্ট অনেক কম হতো। আমাদের সঙ্গে দূতাবাসের ব্যবহার খুব খারাপ। যে বিদেশে আসে সেই জানে প্রবাস জীবন কতটা কষ্টের। এখানে কেউ কাউকে এক টাকা দিয়ে সহায়তা করে না। নিজের পকেটে টাকা না থাকলে কেউ খাওয়াবে না। বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ একটাই দূতবাস আমাদের কথাগুলো যেন শোনে। সহায়তা না করলেও আমরা সান্তনা টুকু পেতে পারি। এখানে আমাদের অভিভাবক তো দূতাবাস। কিন্তু তারা মনে হয় আমাদের চেনেই না।

মালদ্বীপের হোলেমালে শহরে এমন অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা রয়েছেন যাদের সবারই অভিযোগ একই রকম। তারা বলছেন, দূতাবাসে গেলে কোনো ধরনের সহায়তা তো দূরে থাক ভেতরে প্রবেশ করাই যায় না। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশির ভাগ্যে সুখ আর জোটে না। মালদ্বীপে প্রায় ১ লাখের মতো বাংলাদেশি রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটি অবস্থিত এদিকে বাংলাদেশ হাই কমিশন।

প্রবাসী এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ দূতাবাসের হাই কমিশনার মোহাম্মদ নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর সাধারণ জনগণের অভিযোগ থাকবে, এটা নিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়। আমাদের এত বেশি সমস্যা সেটা বাংলাদেশ হাই কমিশনের মতো ছোট একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব না, সবাইকে খুশি করা সম্ভব না। তবে যারা বলছেন হাই কমিশন কথা বলে না— এটা ঠিক না। যারা হাই কমিশনে আসেন আমরা চেষ্টা করি তাদের সঙ্গে কথা বলার।’

তিনি আরও বলেন, যখন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে চুক্তি থাকে তখন আমরা নৈতিক অবস্থানে থাকি এবং জোর করে সেই প্রতিষ্ঠানকে বলতে পারি সমস্যা কেন হচ্ছে। কিন্তু দেখা যায় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রবাসীদের কোনো চুক্তিপত্র থাকে না, তারা মৌখিকভাবে কাজ করেন। ফলে আমরা সেইসব প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করা ছাড়া কিছুই বলতে পারি না। এমনকি সেই প্রতিষ্ঠানকে বলা হলে তারা প্রথমে বলে যেই লোকের অভিযোগ তিনি তার ওখানে নেই। তখন আমরা নিরুপায় হয়ে যাই। তখন আমাদের হাই কমিশনের অবস্থা দুর্বল হয়ে যায় এবং আমাদের কোনো কিছুই করার থাকে না। এমনকি সেই সব প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনার মতো ক্ষমতাও নেই হাই কমিশনের। প্রধান কারণ হলো কোনো প্রবাসীর কাছে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার চুক্তিপত্র থাকে না। আর এটাই হলো বাস্তবতা। ফলে অভিযোগ আর অনুযোগ নিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়।

প্রবাসীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে হাই কমিশনের কর্মকর্তারা— এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাই কমিশনার নাজমুল হাসান আরও বলেন, আমি অভিযোগটি গুরুত্বে সঙ্গে নিলাম। একইসঙ্গে সকল কর্মকর্তাদের তিনি হুঁশিয়ারি করবেন বলেও জানান।

সারাবাংলা/এসজে/এনএস

ঢাকা-মালদ্বীপ প্রবাসী বাংলাদেশি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর