বিজয়ের ৫০ বছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে ৪ গুণের বেশি
১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:১৮
ঢাকা: বিজয়ের ৫০ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪ গুণের বেশি বেড়েছে। প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাহিদা মিটিয়ে দেশ থেকে প্রতিবছর সুগন্ধী চাল রফতানি হচ্ছে। বাজার পরিস্থিতির কারণে মাঝেমধ্যে চাল আমদানি করতে হলেও কৃষির এই প্রধান পণ্যটিতে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। এক সমেয়র লাঙল-জেয়ালের কৃষি এখন অনেকটাই যন্ত্রনির্ভর। সেচ ও চাষে দেশের কৃষি প্রায় পুরোটাই যন্ত্রনির্ভর। রোপন, মাড়াই ও কর্তনেও যন্ত্রের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। মাছ-মাংস ও আলু উৎপাদনেও দেশের কৃষি দেখিয়েছি ঈর্শ্বণীয় সাফল্য। সরকারি বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
কৃষি ক্ষেত্রে অগ্রগতির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার সময়ে দেশে দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি টন। এখন ধানের উৎপাদন ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। গম ও ভুট্টার উৎপাদন ৬৫ লাখ টন। সবমিলিয়ে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪ কোটি ৫১ লাখ টন। অথচ এক সময় ভুট্টার উৎপাদন এক লাখ টনও ছিলনা। সবজির উৎপাদন ১ কোটি ৯৯ লাখ টন, ফলের উৎপাদন ১ কোটি ২৬ লাখ টন।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ফসল উৎপাদনের চাষের ক্ষেত্রে আগে লাঙল ব্যবহৃত হতো। দেশে এখন আর লাঙল নেই। ধান কাটার ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখন ১৫ শতাংশ, এটি আরও খুব দ্রুত বাড়ছে। কীটনাশক স্প্রে করার ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার শতভাগ। আমাদের ১৫ হাজার হারভেস্টার দেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে ৩ হাজার হারভেস্টার দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৫০ শতাংশ ও ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে সরকার কৃষিযন্ত্রপাতি দিচ্ছে। এতে দেশে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ছে।’
সরকারের বিভিন্ন তথ্য বলছে, ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টনের মতো। বর্তমানে সেই উৎপাদন সাড়ে ৪ কোটি টনের বেশি। দেশে ১৯৭১-৭২ দেশে ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে আউশ, ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে আমন, ৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হতো। তখন আউশের উৎপাদন ছিল ২৩ লাখ ৪১ হাজার টন, আমনের ৫৬ লাখ ৯৫ হাজার টন ও বোরো ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টন। দেশে তখন ৯২ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হতো এবং ধানের উৎপাদন ছিল ৯৭ লাখ ৭৪ হাজার টন।
এদিকে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১ লাখ ৩৪ হেক্টর জমিতে আউশ, ৫৮ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন, ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। বছরটিতে ১ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছিল। আর আউশের উৎপাদন ছিল ৩০ লাখ ১২ হাজার টন, আমনের ১ কোটি ৫৫ লাখ টন ও বোরোর উৎপাদন প্রায় ২ কোটি টন। সবমিলিয়ে ধানে উৎপাদন বর্তমানে ৩ কোটি ৮৫ লাখ টনের মতো। স্বাধীনতার পর দেশে আউশের উৎপাদন ছিল হেক্টরে দশমিক ৭৮ টন, বর্তমানে হেক্টরে এই উৎপাদন ২ দশমিক ৬৬ টন। আমনের উৎপাদন ছিল হেক্টরে ১ দশমিক শূণ্য ৫ টন ও বর্তমানে হেক্টরে এই উৎপাদন ২ দশমিক ৬৩ টন। স্বাধীনতার পর দেশে হেক্টরে বোরোর উৎপাদন ছিল ২ দশমিক শূণ্য ১ টন, বর্তমানে হেক্টরে বোরোর উৎপাদন ৪ দশমিক ২৪ টন।
এদিকে অন্য একটি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে দেশে ধানের উৎপাদন ধান ৩ কোটি ৬৩ লাখ টন, গম ১১ লাখ টন, ভুট্টা ৩৭ লাখ টন। মোট ৪ কোটি ১১ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। সম্প্রতিক সময়ে আলুর উৎপাদন প্রায় ১ কোটি টন। ২০ বছর আগে আলুর উৎপাদন ২৫ লাখ টনও ছিলনা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আলুর উৎপাদন প্রায় চার গুণ বেড়েছে। পেঁয়াজের উৎপাদন বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ টন, ২০০৮ সালেও উৎপাদন ছিল ৮ লাখ টনের মতো। তবে এখন ৬ থেকে ৮ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। দেশে ডালের চাহিদা ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন আর উৎপাদন হয় ৭ লাখ টনের মতো। তেলের চাহিদা ২০ থেকে ২২ লাখ টন, দেশে উৎপাদন সর্বোচ্চ ২ থেকে আড়াই লাখ টন।
এদিকে, দেশে ২০০০ সাল পর্যন্ত চাষযোগ্য ধানের জমি বেড়েছে। বর্তমানে তা স্থির রয়েছে। নতুন করে এখন আর ধান আবাদের জমি তেমন করে বাড়ছেনা। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের সেচ এবং চাষের ৯০ ভাগ এখন যন্ত্রনির্ভর। ধান কাটা, ধান লাগানো, সার ছিটানো ও প্যাকেজিংয়ে পিছিয়ে রয়েছে। মাত্র ২ শতাংশ জমি যন্ত্রের আওতায় এসেছে। ধান মাড়াইয়ে ৯০ শতাংশ যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. সাত্তার মন্ডলের মতে, ৭০ দশকে শুধুমাত্র ৬০ টি ট্রাক্টর নিয়ে দেশে যান্ত্রিকরণের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখন সেখানে ৫ লাখ পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর রয়েছে, যা দিয়ে ৯০ ভাগ কৃষি জমি চাষের আওয়াতায় এসেছে। আবাদী ৮০ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৬ লাখ হেক্টর যন্ত্রচালিত সেচের আওয়াতায় এসেছে। সাড়ে ৩ লাখ যন্ত্র রয়েছে মাড়াইয়ের।
কৃষিবিদরা জানান, এক সময় এক ফসণি জমি ছিল ৩২ লাখ হেক্টর। সেটা এখন কমে ২০ লাখ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ সেখানে একাধিক ফসল হচ্ছে। এছাড়া তিন ফসলী জমি ছিল ৯০ এর দশকে ৫ লাখ হেক্টর। এখন তা ১৮ লাখ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে।
মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের (ব্রি.) সাবেক মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, স্বাধীনতার পর দেশে ধানের উৎপাদন ৪ গুণ বেড়েছে। কিছুদিন আগে গমের উৎপাদন একটু কমে গিয়েছিল, এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। দেশে ভুট্টার উৎপাদন প্রায় ৯০০ গুণ বেড়েছে। মাছের উৎপাদন এখন ঈর্শ্বণীয়। ডিম ও দুধে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে সারাবছর এখন সবজি পাওয়া যাচ্ছে। কৃষি গবেষণায় দেশ অনেক এগিয়ে গেছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘চাল আমদানি করতে হয় কারণ কখনও উৎপাদন বেশি হচ্ছে আবার কখনও কম হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চাল আমদানি করতে হয়। তবে আমরা চাল রফতানিও করছি। সব মিলিয়ে চালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণই।’ তিনি আরও বলেন, ‘বৈরি পরিবেশের জন্য অঞ্চল ভিত্তিক ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে হবে। কৃষক যেন ফসল উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে নিশ্চিত থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের শস্যবীমা প্রচলন করা জরুরি। ডিজিটাল সার্ভিস যেন কৃষকের দৌড়গোড়ায় দ্রুত নিয়ে যেতে পারি তা নিয়ে কাজ করতে হবে। উদ্ভাবনে আমাদের আরও বেশি জোর দিতে হবে।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ফেলো ও কৃষি অথর্নীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘৭১ সালের তুলনায় কৃষি ক্ষেত্রের অর্জনে এখন বিশাল তফাৎ। কৃষির সমস্ত উপখাতে আমরা অনেক এগিয়েছি। অনেক দূর এগিয়ে গেছি। প্রধান ফসলে আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের প্রোটিন জাতীয় পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু আমরা এখনও দেশের ডাল খাই না। মসলা জাতীয় ফসলের ক্ষেত্রে বাইরের ওপর নির্ভরশীল। বড় বড় খাদ্যশস্য বা পণ্যে এগিয়ে গেলেও ছোট পণ্যে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। মাছ-ভাতে বাঙালি। দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু তারপরও সবাই মাছ খেতে কিন্তু পারছে না। আবার ভাত-দুধে বাঙালি বলা হয়, কিন্তু দেশে দুধ কতোটুকু হয়েছে সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আবার ডাল দেশে কতোটা হচ্ছে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। ডাল বাইরে থেকেই আমদানি হচ্ছে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জমি চাষের ক্ষেত্রে এখন প্রায় পুরোটাই যন্ত্রনির্ভর। কিন্তু ধান কাটা ও মাড়াইয়ে সব ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীরণ হবে না। আবার সব কিছু যান্ত্রিকীরণ করতে গেলে, সামাজিক ফলাফল চিন্তা করতে হবে। কৃষি শ্রমিক যাবে কোথায়, তাদের তো পেটে ভাত লাগবে। আবার ১৫ লাখ টাকা দিয়ে কম্বাইন্ড হারভেস্টার কোন কৃষক কিনতে পারবে? ভর্তুকি দেওয়া সত্ত্বেও তা কৃষকের কেনার উপযোগী কিনা তা আমাদের ভাবতে হবে। সবমিলিয়ে কৃষির অনেক ক্ষেত্রেই এখন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’
কৃষিবিদরা বলছেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এখন সবার জন্য পুষ্টি নিশ্চত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া কৃষির যান্ত্রিকীরণও এখন সরকারের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। কৃষির বাণিজ্যকীকরণ ও বহুমুখীকরণ নিয়ে সরকার কাজ করছে। কৃষি পণ্যের রফতানি বাড়াতে নানামুখী তৎপরতার কথাও জানিয়ে আসছে সরকার। এসব করতে পারলেই দেশের কৃষি আরও বহুদুর এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন কৃষিবিদরা।
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে