Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিজয়ের ৫০ বছর: তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নের রোল মডেল

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ১৪:৫৮

ঢাকা: উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ২০২১ সালে বিজয়ের ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে বাংলাদেশ। কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ির খেতাব পাওয়া বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ। ২০৩২ সালে বিশ্বের বড় অর্থনীতির ২৫টি দেশের একটি হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। ১৯৭১ সালে যে দেশটির প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যপীড়িত ছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছরে সারাবিশ্বের কাছে সেই দেশটি উন্নয়নের এক রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে এই উন্নয়নের প্রশংসা করা হচ্ছে। বিজয়ের ৫০ বছরে সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান করে নিয়েছে। সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ যতটা উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল- অনিয়ম, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তা সম্ভব হয়নি বলেও অর্থনীতিবিদদের অভিমত।

২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ৫০তম মহান বিজয় দিবস পালন করছে। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে দেশের জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসক ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত ও দুই লাখ মা বোন সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার আগে অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যর পাশাপাশি ক্ষুধা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্যহীনতাসহ নানা কারণে আয়ুষ্কালও ছিল অনেক কম। শিক্ষার হার ছিল নিম্নপর্যায়ে। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানও ছিল না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে গত ৫০ বছরে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বর্তমানে উন্নয়নের বিস্ময় এক বাংলাদেশ। এই সময়ে মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, কমেছে মাতৃও শিশু মৃত্যুর হার। মেইড ইন বাংলাদেশ নামে বিশ্বে পরিচিতি দিয়েছে পোশাক খাত।

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ৩০ জুন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এই সময়ে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৬৮ গুণ। এছাড়াও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ১৯৭২ সালে যেখানে ৫০১ কোটি টাকা ছিল, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে দেশে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে রয়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে করোনা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১২৯ ডলার। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। এই সময়ে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ২০ গুণ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আগে শতভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হতো বৈদেশিক অনুদান থেকে। এখন প্রায় ৬৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় দেশীয় সম্পদের উৎস থেকে।

সূত্র জানায়, গত ৫০ বছরে আশানুরূপ অর্জন এসেছে রফতানি বাণিজ্যেও। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় হয় মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। করোনা মহামারির মধ্যেও সর্বশেষে ২০২০-২১ অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২৫ বিলিয়র ডলার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশেন মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল ৮ বিলিয়ন ৭৫ লাখ ডলার বা ৮০০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ১৯৭২ সালের বাজেটে জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল মাত্র ১১২ টাকা। বর্তমানে তা ২০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রথম তিন বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত এক দশকে প্রবৃদ্ধির গড় হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে মোট জিডিপি‘র আকার ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ১৯৭২ সালে শূন্যের ঘরে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ১৯৭১ সালে দেশে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্যানুয়ায়ী, দেশে দারিদ্র লোকের সংখ্যা ২৫ শতাংশ। ১৯৭১ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ দশমিক ৫১ বছর বর্তমানে গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ দশমিক ৮ বছর।

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক ও অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির আকার বহুগুণে বেড়েছে। শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। বেড়েছে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।’

মির্জা আজিজ বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। স্বাধীনতা অর্জনের সময় আমাদের প্রায় ৮০ শতাংশ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে ছিল। করোনার আগ পর্যন্ত দারিদ্র জনিগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিল। করোনার প্রভাবে বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ লোক দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। ফলে স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা যথেষ্ট উন্নতি করেছি।’

সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি লাভ করলেও বাংলাদেশের সমসাময়িক সময়ে যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে সে দেশগুলোর অর্থনীতির অগ্রগতির তুলনায় আমাদের অর্জন অনেকটাই মলিন। বিশেষ করে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা দিয়ে আমাদের বাজেট শুরু করেছিলাম। বর্তমানে বাজেটের আকার ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আমাদের জিডিপি কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে। এসব কিছু নিয়ে আমরা বলতেই পারি, আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতি প্রশংসনীয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির এই অগ্রযাত্রার প্রধান কারণ হলো- এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে বসবাসকারী জনগণ একসঙ্গে থাকি, এক ভাষায় কথা বলি, চালচলন, চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক আচার আচরণ একই রকম। এটা বজায় রাখতে পারলে এবং কিছু রাজনৈতিক বিভাজন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলে আমরা আরও এগিয়ে যাব।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর আরও বলেন, ‘দুর্নীতি আমাদের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করেছে। দুর্নীতি যদি কমিয়ে আনা যায় তাহলে আমাদের কর আদায় বেড়ে যাবে। তাতে করে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হবে।’

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা কতটা এগিয়েছি এটা আপেক্ষিক ব্যাপার। কারণ আমাদের সম-সাময়িক যেসব দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে তাদের অনেকেই আমাদের চেয়ে এগিয়েছে। আবার বেশ কিছু দেশ পিছিয়েছে। তবে আমরা সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছি। দুর্নীতি কমানো সম্ভব হলে অর্থনীতি আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো।’

তিনি বলেন, ‘ষাটের দশকে চীন, পাকিস্তান একই অবস্থানে ছিল। তাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৬০/৭০ ডলার। বর্তমানে চীনের মাথাপিছু আয় ১৩ হাজার ডলার, আর আমাদের আড়াই হাজার ডলার। ১৯৯০ সালে রফতানিতে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম একই অবস্থানে ছিল। বর্তমানে ভিয়েতনাম ২৭০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। আরও বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ মাত্র ৩৮ বিলিয়ন ডলার।’

সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম

তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নের রোল মডেল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার শাজাহান খান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০২:৪৫

সম্পর্কিত খবর