স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী: প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ৫০
১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ২২:৫০
ঢাকা: ১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ মধ্য রাতে বাঙালি দেখেছিল এক বিভীষিকাময় দৃশ্য। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি শাসন শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম আর সেনাবাহিনীর সঙ্গে নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে আসা সেই স্বাধীনতা পঞ্চাশে পা রেখেছে। দীর্ঘ এই যাত্রা পথও বাঙালির জন্য সহজ ছিল না। একটা র্দীঘসময় সামরিক শাসন আর রাষ্ট্র ক্ষমতার রদবদলে মুছে যাচ্ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সে অবস্থা থেকে টেনে তুলে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ইতিহাসের সঠিক তথ্য তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিয়েছেন তাদের প্রাপ্য মর্যাদা সম্মান। কাজ করে যাচ্ছেন তাদের কল্যাণে। দীর্ঘ এই পথ-পরিক্রমায় প্রাপ্তি যেমন, অনেক অপ্রাপ্তিও রয়ে গেছে। সে অপ্রাপ্তি দূর করতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের পাশাপাশি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা চূড়ান্ত, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশার দাবি বিশ্লেষকদের।
স্বাধীনতা লাভে নেতৃত্বের পাশপাশি জীবনবাজি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধ শেষে ধ্বংসস্তুপ থেকে বাংলাদেশকে টেনে তুলতে দিন রাত এক করে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বের কাছ থেকে শুধু বাংলাদেশের স্বীকৃতিই আদায় করেননি, পরিচিত করেছেন বাঙালি হিসেবেও। সদ্য একটি দেশ হিসেবে যখন ধীরে ধীরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ঠিক তখনি বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে সকল উন্নয়ন শেষ করে দিচ্ছিলো স্বাধীনতাবিরোধী শত্রু। জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু বাংলাদেশকে অভিভাবকশূন্যই করা হয়নি, মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল চেতনার যে রাষ্ট্র দর্শন সেই শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচিন্তাকেও নিঃশেষ করা হয়েছিল।
স্বাধীনতা লাভের পর একটা দীর্ঘ সময় স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী দল ক্ষমতায় ছিল। ওই সময়ে বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে্। বিকৃত করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। স্বাধীন দেশের লাল সবুজের পতাকা উড়েছে তাদের গাড়িতে। এটি ছিল ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়। জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর কথা মানুষ মুখে নিতে পারেনি। ফলে কয়েক প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস জেনে বড় হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে বাংলাদেশের মানুষকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২০০৮ সালে পূনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহন করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায়। তার সময়ে সম্মানিত হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সকল বিদেশি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সম্মানিত হয়েছেন তারাও। ভাতা বৃদ্ধি, আবাসন সুবিধা, চিকিৎসাসহ নানা সুবিধা পাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলো। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সে বিচার এখনো চলমান। সরকারের এই উদ্যোগ সাহসী অভিহিত করে বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাতেই একাজ সফল করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
লেখক, গবেষক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া একটি স্বাধীন দেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু একটা অসাধারন সংবিধান উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের। যেখানে ধর্মের নামে রাজনীতি, ধর্মের নামে হত্যা সন্ত্রাস বন্ধের কথা বলা হয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই সংবিধান। এটি রক্ষার দায়িত্ব আগামী প্রজন্মের। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছেন সেই মেজর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে প্রথমেই সংবিধানকে হত্যা করলেন। সংবিধানে মৌলবাদী পাকিস্তানিকরণ করলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করলেন, গণহত্যাকারীদের ওপরে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটাও তুলে নিলেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিষ্ঠিত করলেন।’
তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরের পর থেকে স্বাধীনতা বিরোধীরা দীর্ঘ সময় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতায় ছিলেন। ইতিহাস বলছে, যে সকল দেশ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে, সেসব দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের কোনো স্থান থাকে না। বাংলাদেশ হলো এমন দেশ যেখানে স্বাধীনতার পক্ষের এবং বিপক্ষের উভয় শক্তিও রাজনীতি করে। এই রাজনীতি জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। এসব কাটিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা যে সব উদ্যোগ নিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে সাহসী পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু ও কার্যকর যে জাতিকে কলংকমুক্ত করেছেন।
এই প্রাপ্তির পাশাপাশি অপ্রাপ্তিও রয়েছে বলে মনে করেন এই গবেষক। তিনি বলেন, ‘প্রাপ্তি অনেক আছে আবার অপ্রাপ্তিও আছে। স্বাধীনতার এতো বছরেও আমরা রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রণয়ন করতে পারিনি। চূড়ান্ত করা যায়নি শহীদ বুদ্ধিজীবিদের পূর্নাঙ্গ তালিকা। একাত্তরে গণহত্যার বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করা যায়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেমে রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা সংবিধানে পরিচালিত হবে সে নীতি থেকে আমরা এখনও দূরে। শিক্ষা সংস্কৃতিতেও আমাদের সংবিধানের সেই নীতি প্রতিফলিত হয়নি।’
তিনি প্রশ্ন রাখেন সরকারের এজেন্ডায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গুরুত্ব কমে গেছে কি না?
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মতো কিছু সংগঠন এ নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ নেই। ধর্মের নামে রাজনীতি, ধর্মের নামে ব্যবসা বাড়ছে। সমাজে সাম্প্রদায়িকীকরণ হচ্ছে, মৌলবাদ ছড়াচ্ছে, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাকিস্তানি মত ধারার শক্তি বিরাজ করছে। এগুলো আমাদের অপ্রাপ্তির বিষয় রয়েছে। এ নিয়ে কাজ করতে হবে। জাতির পিতার যে স্বপ্ন একটি শোষনমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন সে সপ্ন পূরনে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত করা হয়েছে। চলমান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির কাজ। যদিও করোনার কারণে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনের কাহিনি নিয়ে ভিডিও চিত্র করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সে সব কাজও শুরু হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সুত্র অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬০ জন। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতা ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করার ঘোষনা করেন। এর বাইরে বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারকে মাসিক ৩৫ হাজার, বীর উত্তদের জন্য মাসিক ২৫ হাজার, বীর বিক্রমদের জন্য, ২০ হাজার টাকা এবং বীর প্রতিকদের জন্য মাসিক ১৫ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হচ্ছে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার এবং সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকা হারে মহান বিজয় দিবস ভাতা দেওয়া হচ্ছে। আর জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা হারে মহান বিজয় দিবস ভাতা এবং সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে ভাতার ২০ ভাগ হারে বাংলা নববর্ষ ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
সারাবাংলা/জেআর/একে