৫ দশকে কতটা ক্ষমতায়ন হলো নারীর?
১৭ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:৪০
ঢাকা: বিজয়ের পাঁচ দশক উদযাপন করছে জাতি। ৫০ বছর আগে মুক্তির নিঃশ্বাস নেওয়া বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে এখন উন্নয়নশীল দেশ। অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। পাঁচ দশকের এই পথপরিক্রমায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নেও রয়েছে অনেক অগ্রগতি। তারপরও বিরাজমান পিতৃতান্ত্রিক সমজাব্যবস্থায় নারীর পথচলা এখনো সহজ নয়। আজও ঘরে-বাইরে নারী নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি। বেড়ে চলা নির্যাতন, অবহেলা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণে বাধাসহ নানা সমস্যায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে অতৃপ্তিও কম নয়।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে নারীর ক্ষমতায়ন কতটা হলো— চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এমন প্রশ্নের জবাবে তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রশ্নের জবাব এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ হিসেবে দেওয়া সম্ভব না। তারা বলছেন, এখনো নারীমুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সার্বিকভাবে নারীবান্ধব সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতির চিত্র
নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে শিক্ষা, অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলোই আসে সবার সামনে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এ বছরের আগস্টের মাসিক পরিসংখ্যান বুলেটিনের (নভেম্বরে প্রকাশিত) তথ্য বলছে, দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের স্বাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এই বয়সী নারীদের স্বাক্ষরতার হার ৭৩ শতাংশ। অন্যদিকে সবশেষ শ্রম জরিপের তথ্য বলছে, দেশের মোট কর্মজীবী নাগরিকের প্রায় ৩৮ শতাংশ নারী। শ্রমজীবী নারীর সিংহভাগই অবশ্য তৈরি পোশাক খাতে নিয়োজিত। বড় একটি অংশ নিয়োজিত কৃষি খাতেও।
এর বাইরেও সেবা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। প্রশাসনসহ সরকারি বিভিন্ন দফতরে বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ। চলতি বছরের মার্চের হিসাব বলছে, দেশে সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ৭৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে ১০ জন নারী, ৫১১ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে নারী ৮৩ জন, ৬৩৬ জন যুগ্ম-সচিবের মধ্যে নারী ৮১ জন, ৬৯৫ উপসচিবের মধ্যে নারী ৩৪৯ জন, এক হাজার ৫৪৯ জন সিনিয়র সহকারী সচিবের মধ্যে নারী ৪৫৪ জন এবং এক হাজার ৫২৮ জন সহকারী সচিবের মধ্যে নারী ৪৭২ জন। স্থানীয় প্রশাসনে দেশের ৬৪ জেলায় জেলা প্রশাসক পদে রয়েছেন ১০ নারী।
বিচার বিভাগেও নারীদের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে কোনো নারী বিচারপতি নেই। হাইকোর্ট বিভাগে আছেন ছয় জন, অধস্তন আদালতে আছেন চারশ নারী বিচারক। ১৯৭৪ সালে সাত জন নারী উপপরিদর্শক (এসআই) ও সাত জন নারী কনস্টেবল নিয়োগের মাধ্যমে পুলিশ বিভাগে নারীরা অন্তর্ভুক্ত হন। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত নারী ১৫ হাজার ১৬৩ জন, যা মোট সদস্যের ৭ দশমিক ০৯ শতাংশ। বর্তমানে দু’জন ডিআইজি, দু’জন অ্যাডিশনাল ডিআইজি, ৭১ জন পুলিশ সুপার, ১০৯ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ১০০ জন সহকারী পুলিশ সুপার রয়েছেন।
কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলেও বিভিন্ন খাতে অংশগ্রহণে নারীর আর্থিক ক্ষমতায়ন বেড়েছে। এর প্রতিফলন হিসেবে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। কারণ নারী সচেতন হওয়ায় তারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছে, অসুখে চিকিৎসা করাচ্ছে, নিয়মিত টিকা দিচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যা তাদের সচেতনতা বাড়ানোতে ভূমিকা রেখেছে।
ইউএনডিপির এ দেশে নিযুক্ত প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, নারী হিসেবে আমাকে কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নিয়োগ দেওয়াও এক ধরনের প্রাপ্তি, যা কয়েক দশক ধরে নারীর ক্ষমতায়নের ধারাবাহিক প্রভাবেই সম্ভব হয়েছে। উপবৃত্তির মাধ্যমে নারীর শিক্ষার প্রসারের ফলে নারীরা অনেক বেশি কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন, যা তাদের এক ধরনের ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে। তবে নারীর ক্ষমতায়নের নানা নীতি থাকলেও বাস্তবায়নে সমস্যা রয়েছে। সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।
নারী শিক্ষায় অগ্রগতি হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তৈরি হয়েছে কি না— জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও উন্নয়নকর্মী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমিও বলব— শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় অনেক দূর যেতে হবে। অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়া মানেই অংশীদারিত্ব নয়। সমাজের ঘরে-বাইরে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের হার অনেক নগণ্য।
স্বাক্ষরতা ও উচ্চ শিক্ষার হার বাড়লেও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের হার সন্তোষজনক কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেয়েদের জন্য সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্র তৈরি হলেও এখনও পারিবারিক ও সামাজিক অনেক বাধার কারণে নারীরা এগিয়ে যেতে পারছে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর কারণে এখনো বদলির চাকরি বা চ্যালেঞ্জিং চাকরিতে ঢুকতে নারীকে বাধা দেওয়া হয়। শিক্ষা খাতে অনেক নারী নিয়োজিত থাকলেও শিক্ষা প্রশাসনে উপস্থিতি কম। আবার অন্যান্য উচ্চ পদেও নারীর সংখ্যা সন্তোষজনক নয়। গত ১০ বছরে এ ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি, তা মূলত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা এখনো সব ক্ষেত্রেই ঢের পিছিয়ে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে অনেক অগ্রগতি যেমন আছে তেমনি অতৃপ্তিও আছে। নারীর ক্ষমতায়ন যথেষ্ট হলেও এ নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। ক্ষমতায়নের প্রশ্নে এবং শ্রমবাজারে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, যেগুলো মোকাবিলা করতে হবে। স্বাধীনতার পর যেখানে ছয় শতাংশের কম নারী শ্রমবাজারে ছিলেন, এখন সেটি ৩৫ শতাংশের বেশি। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্য দূর হওয়ায় শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক দিকে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এতে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও বদল এসেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ তৈরি হওয়ায় জ্ঞানের জগতের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন
নারী ক্ষমতায়নের প্রশ্নে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক পদগুলোতে নারীদের আসীন হওয়ার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার— অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদেই আসীন নারী। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রকৃতপক্ষে নারীর অবস্থান কোথায়? রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে নারীদের অন্তর্ভুক্তির বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটির বাস্তব প্রতিফলন নেই। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রেসিডিয়ামসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশেও নারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম, যদিও নারীদের জন্য আলাদা করে সহযোগী সংগঠন রয়েছে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া ৪৮ সদস্যের মন্ত্রিসভায় নারী মন্ত্রী চার জন। ২৫ জন পূর্ণ মন্ত্রীর মধ্যে এক জন নারী, দু’জন প্রতিমন্ত্রী ও এক জন উপমন্ত্রী। স্থানীয় সরকারে ৪৬০টি উপজেলার মধ্যে ১৪৯টি উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান নারী। জাতীয় সংসদে এখনো সংরক্ষিত আসনগুলোতে নারীরা এখনো ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে মনোনীত হন, যে রীতি চলে আসছে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের সময় থেকে।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বাধ্যতামূলক ৩৩ শতাংশ নারী সদস্যের দাবি জানিয়ে এলেও তারা সেটি পূরণ করছেন না। এর ফলে উচ্চ পদে নারীরা আসীন থাকলেও রাজনীতির সব স্তরে সেভাবে নারীর উপস্থিতি নেই।
বর্তমান সময়ের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, শীর্ষ পদে নারীর থাকা দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন বোঝানো যায় না। এটি অনেকটা অলঙ্কারের মতো। তাছাড়া উচ্চ পদে আসীন নারীরা পুরুষতন্ত্রকেই লালন করছেন। তাই নারীর ক্ষমতায়ন করতে হলে পুরুষতন্ত্রকে শেষ করতে হবে। নারী ও পুরুষ উভয়কেই নারী অধিকারের জন্য কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সব রাজনৈতিক দলকে ঢালাওভাবে বিচার করা যাবে না। যারা হালুয়া-রুটির রাজনীতি করে, তারা দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে। তারা নারীকেও দুর্বল মনে করে। তাই তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখে। এসব কারণেই আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রেসিডিয়ামসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি কম। এছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে নারীকে পণ্যায়ন করা হয়েছে। এর প্রতিফলন এখন রাজনীতিতেও দেখা যাচ্ছে।
নারী নির্যাতনের চিত্র হতাশাব্যঞ্জক
পাঁচ দশক আগের চিত্র দেখলে নারীর ঘর থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়াকে ইতিবাচক মনে হলেও এর বিপরীতে নারী নির্যাতনের চিত্র হতাশাব্যঞ্জক। করোনাভাইরাস সংক্রমণে যখন সবাই ঘরবন্দি ছিলেন, তখন নারী নির্যাতনের পরিমাণ বেড়েছে। বেড়েছে বাল্যবিয়ে। বিজয়ের ৫০ বছরের সন্নিকটে এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্রীকে জীবন দিতে হচ্ছে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে। পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে নারী নির্যাতনের কোনো না কোনো ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করছে— এমন ঘটনা ঘটছে নিয়মিতই। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জরিপের তথ্য বলছে, গত নভেম্বরেও ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুর সংখ্যা ছিল অক্টোবরের প্রায় দ্বিগুণ।
সব মিলিয়ে ৫০ বছরে নারী নির্যাতন বেড়েছে বলেই মনে করেন সমাজ অধিকারকর্মী ও নারীনেত্রী খুশী কবীর। নারীর ঘরের বাইরে আসা, সাফল্য, অর্থ উপার্জন মেনে নিতে না পারাকেই তিনি এর অন্যতম কারণ মনে করেন।
খুশী কবীর বলেন, পুঁজিবাদের অনেক ভালো দিক গ্রহণের পাশাপাশি নারীকে যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে উপস্থাপন ও ব্যবহার করতেও শিখেছি। ফলে নারীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। স্বাধীনতার পরপর তারা যখন রাস্তায় বের হতেন বা গণপরিবহণ ব্যবহার করতেন, তখন এমন টিজিং বা নির্যাতনের শিকার হতে হতো না।
তিনি বলেন, নারীমুক্তি প্রসঙ্গে সমাজে অনেক অগ্রগতি হলেও অনেক ইতিবাচক দিকই এই সময়ে হারিয়েও গেছে। সামাজিকভাবে প্রভাব রাখতে সক্ষম নারীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আইনে নিষিদ্ধ হলেও কৌশলে যৌতুক লেনদেনের প্রবণতা বেড়েছে। এই যৌতুকের কারণে অনেক মা-বাবাকে সর্বস্বান্ত হতে হয়, মেয়েকে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়। কমেনি বাল্যবিয়েও। অনেক ক্ষেত্রেই কিশোরীরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে বাল্যবিয়ে ঠেকালেও বরং করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। আবার বৈবাহিক ধর্ষণও ঘটেই চলেছে।
নারীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তির এই যুগে সাইবার হয়রানিকেও নতুন চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান। কর্মস্থলে নারীদের বৈষম্যের শিকার হওয়ার প্রবণতা বিলোপ না করতে পারাতেও ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তিনি। পাশাপাশি শ্রমবাজারে নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য অতটা প্রকট না হলেও উচ্চপদে নারীর সংখ্যা নগণ্য হওয়ায় সামগ্রিক ক্ষমতায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
কাঠগড়ায় পুরুষতন্ত্র
বিভিন্ন সূচক এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়— বাল্যবিয়ে, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে বাধা, পরিবার ও সমাজে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে বাধাসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে নারী। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকেই এর পেছনে প্রধানতম কারণ হিসেবে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামো থেকে বের না হতে পারায় নারীবান্ধব একটি দেশ গড়তে আমরা পিছিয়ে আছি।
নারী অধিকারকর্মী খুশী কবীর বলেন, ৫০ বছরে নারীর কাজের পরিধি বেড়েছে। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে এখনো নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে যেতে পারছে না। সে এখনো কোনো না কোনো পুরুষের অধীন। নারী এখন নানা কাজে নিজে বাইরে যায়, মিডিয়া ও এনজিওকর্মীদের মাধ্যমে তথ্য পায়, নানাভাবে অর্থ উপার্জন করে। কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে তার কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো বিয়ে না করলে, বিয়ে ভেঙে গেলে, বাবার বাড়ি থাকলে নারীকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়। এখনো নারীর ঠিকানা হয় বাবার বাড়ি, না হয় শ্বশুরবাড়ি। তার নিজের ঠিকানা নেই। অন্যদিকে ছেলেদের জন্য বাবার বাড়িই তার বাড়ি। এসব নানাবিধ সামাজিক সমস্যা এখনো বিরাজমান।
উত্তরণের উপায় হতে পারে নিরাপদ কর্মপরিবেশ
পুরুষতান্ত্রিক চর্চার বাস্তবতায় নারীদের আরও বেশি কর্মমুখী করে তোলাকেই নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম উপায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নারীর কর্মপরিবেশকে নিরাপদ করতে হবে। নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুবিধা দিতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়নে পথ মসৃণ করতে তিনটি সুপারিশ তুলে ধরেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, কৃষিসহ শ্রমবাজারে নারীর কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারীকে আরও বেশি নিয়োজিত করতে হবে। এজন্য তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনে সহজ শর্তে ঋণের সুব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, কর্মজীবী নারীদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজের যে অংশের নারীরা পিছিয়ে আছে, তাদের বিশেষভাবে সহায়তার আওতায় আনতে হবে। সবশেষে নারী উদ্যোক্তাদের ছোট ছোট ব্যাবসায় সাহায্য করতে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে হবে, যার শুরুটা করতে হবে তৃণমূল পর্যায় থেকে।
পরিস্থিতি নারীর অনুকূলে আনতে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনার তাগিদ দেন রাশেদা কে চৌধুরী। এ ক্ষেত্রে তিনিও কর্মক্ষেত্রে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র ও নারীর চলাচলের নিরাপদ পরিবেশের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। সরকার একা নয়, সবাই মিলেই এই কাজগুলো করলে তবেই দেশে সত্যিকারের নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হবে— এমনটিই মন্তব্য তার।
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, নারী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। শহুরে নারীরা উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পেলেও গ্রামীণ নারীরা পিছিয়ে আছেন। তাই বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের টার্গেট করে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিলে তারা অর্থনীতিতে আরও অবদান রাখতে পারবেন ও সমাজ পরিবর্তনে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারবেন।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
নারীমুক্তি নারীর অগ্রযাত্রা নারীর ক্ষমতায়ন পুরুষতান্ত্রিকতা বিজয়ের ৫০ বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী