রায়ের কপি পেতে যেন ঘোরাঘুরি করতে না হয়: রাষ্ট্রপতি
১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ২০:৫৬
ঢাকা: রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, বিচারকদের খেয়াল রাখতে হবে, মামলার রায় হওয়ার পর, রায়ের কপি পাওয়ার জন্য বিচারপ্রার্থীদের যেন আদালতের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করতে না হয়।
শনিবার (১৮ ডিসেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের জাজেস স্পোর্টস কমপ্লেক্সে সুপ্রিম কোর্ট দিবস-২০২১ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন রাষ্ট্রপতি।
মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে মানুষে মানুষে থাকবে না ভেদাভেদ, থাকবে না ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, জনগণ অত্যন্ত কম খরচে অল্প সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার লাভ করবে। জাতির পিতা সংবিধানে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালত নিজ নিজ এখতিয়ার ও সীমার মধ্যে স্বাধীনভাবে আইন অনুসারে বিচার কাজ পরিচালনা করবে।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ নিশ্চিত হয় যখন ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তার যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং স্বল্প সময়ে বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার পাওয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন। শান্তি ও সঙ্কটে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক ও রক্ষক হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।’
দেশের সংকটে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বিনির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। পাস করে সংবিধানবিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। তারা ভেবেছিল, আর কখনো তাদের বিচার হবে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ষড়যন্ত্রকারীদের সেই নীল নকশা বাস্তবায়িত হতে দেননি। প্রথমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানবিরোধী ঘোষণা করে এবং শেষ পর্যন্ত জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার করে সুপ্রিম কোর্ট তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতি আজ সেই কলঙ্ক থেকে কিছুটা হলেও দায়মুক্ত।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে সংবিধানকে নানাভাবে কাটা-ছেঁড়া করে গণতন্ত্রকে চিরতরে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জনতার প্রতিরোধের মুখে স্বৈরশাসকদের পতন হয়েছে। স্বৈরশাসকেরা তাদের পতনের পূর্বে অবৈধভাবে সংসদকে ব্যবহার করে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী পাসের মাধ্যমে তাদের সমস্ত কুকীর্তিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতির ক্রান্তিকালে যখনই প্রয়োজন হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সংবিধানকে রক্ষা করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট দিবসের অনুষ্ঠানে আমি কৃতজ্ঞতাসহ স্মরণ করছি সুপ্রিম কোর্টের সেই অকুতোভয় বিচারপতিদের, যারা বন্দুকের নলের কাছে নতি স্বীকার করেননি। তাদের বিবেককে কখনো বিকিয়ে দেননি। এ ছাড়া বিজ্ঞ আইনজীবীদের ভূমিকাও আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিচারকাজ একটি জটিল বিষয়। কিন্তু তারপরেও আমি বলব। মামলার পরিমাণ দিন দিন যে হারে বাড়ছে সেটিকে আয়ত্তের মধ্যে আনতে হলে বিচারকদের আরও বেশি কাজ করতে হবে। সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এবং বিচারকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিচারকদের খেয়াল রাখতে হবে মামলার রায় হওয়ার পর রায়ের কপি পাওয়ার জন্য বিচারপ্রার্থীদের যেন আদালতের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করতে না হয়।’
বিচার ব্যবস্থায় আইনজীবীদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আইনজীবীরা বিচার ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ। বিচার কাজে আইনজীবীদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সংবিধান প্রণয়নের সময় যেমন দেশের প্রথিতযশা আইনজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তেমনি যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই আদালতের ডাকে সাড়া দিয়ে এমিকাস কিউরি হিসেবে তাদের মতামত দিয়ে আদালতকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেছেন।’
বিচার ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তির গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন। প্রযুক্তির উৎকর্ষে মানুষ নানা ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করছে। এই যুগচেতনার সন্ধিক্ষণে আদালত ব্যবস্থাপনায়ও আমূল পরিবর্তন এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির সমস্ত সুবিধা ব্যবহার করে মামলা ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য ২০২০ সালের ৯ মে আদালতের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ জারি করা হয়; যা পরবর্তীতে আইনে পরিণত হয়। করোনাকালে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতের বিচারক ও আইনজীবীরা বিচারপ্রার্থী জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এ জন্য আমি বিচার বিভাগকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দেশের সব আদালতের কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে বিচার কার্যক্রমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে।’
ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের অনলাইন কজ লিস্ট চালু হয়েছে। অনলাইন বেইল (জামিন) কনফার্মেশন ব্যবস্থার কার্যক্রম চলছে। সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু কোর্ট অব রেকর্ড সেহেতু একে ডিজিটাল রেকর্ডে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এবং মামলা দায়ের থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করাও জরুরি। বিচার বিভাগের আধুনিকায়নে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। এবং এই লক্ষ্য অর্জনে ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, বিশেষ অতিথি হিসেবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বক্তব্য দেন। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন।
এদিন আলোচনা সভায় আপিল ও হাইকোর্টের বর্তমান ও সাবেক বিচারপতি, আইনজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দিবস উদযাপন উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্টের স্থাপনার ছবি সম্বলিত একটি স্মারক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
সারাবাংলা/কেআইএফ/একে