নৌকার ঘাঁটিতেও ‘দ্বন্দ্ব’, ঐক্যে জয় খুঁজছে আ.লীগ
২০ ডিসেম্বর ২০২১ ২৩:৫৮
ঢাকা: রাজধানী সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) এলাকা আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবেই পরিচিত। এই সিটিতে সবশেষ দুই নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। তারপরও এবারের নির্বাচন ঘিরে একেবারে নিঃসংশয় নয় ক্ষমতাসীন দলটি। স্থানীয় রাজনীতিতে বর্তমান মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলয় অনেকটাই মুখোমুখি। সে কারণেই এই নির্বাচন ঘিরে ‘দ্বন্দ্বে’র আভাস দেখছে দলের হাইকমান্ড। আর সে কারণেই নাসিক নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আইভীকে জয়ী করতে মাঠে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প দেখছে না কেন্দ্র।
আগামী ১৬ জানুয়ারি ভোট হবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে। এই নির্বাচনে বর্তমান মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপরই ভরসা রেখেছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। অন্যদিকে আগের ঘোষণা অনুযায়ীই এই নির্বাচনে নেই বিএনপির দলীয় প্রার্থী। তবে আইভীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। স্বাভাবিকভাবেই তিনি বিএনপির সমর্থন পাবেন— তা নিয়ে সংশয় নেই কারও। এর সঙ্গে শামীম ওসমানের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতির দূরত্ব প্রভাব ফেললে আইভীর জন্য নির্বাচনের মাঠ কণ্টকমুক্ত থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য।
এসব কারণেই কারণেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসকেই গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্র। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ সবসময়ই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। দল ঐক্যবদ্ধ থাকলে নাসিক নির্বাচনে নৌকার বিজয় নিয়ে সংশয় থাকবে না।
আরও পড়ুন- উনি অবশ্যই নৌকার জন্য কাজ করবেন— শামীম ওসমান প্রসঙ্গে আইভী
সোমবার (২০ ডিসেম্বর) সকালে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলের পক্ষে নাসিক নির্বাচন পরিচালনা টিমের মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। তবে প্রায় চার ঘণ্টার এই বৈঠকে উপস্থিত হননি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তবে জেলার বাকি নেতারা ঠিকই উপস্থিত ছিলেন। এমনকি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিপক্ষে যারা মনোনয়ন কিনেছিলেন, তারাও ছিলেন উপস্থিত। অন্যদিকে শামীম ওসমান না থাকলেও তার অনুসারীদের যারা নাসিকে নৌকার প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছিলেন, তাদের মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চন্দন শীল উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রেখেছেন। তারা তিন জনই মূলত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের অনুসারী বলে পরিচিত।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী গ্রুপের বিভেদ চরম পর্যায়ে রয়েছে। দল থেকে বর্তমান মেয়রকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ায় মাঠে নেই শামীম ওসমান। সরাসরি বিরোধিতা না করলেও তিনি যে আইভীর প্রচারণায় থাকছেন না, সেটি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে।
এদিকে, এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনায় আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানককে সমন্বয়ক এবং ঢাকা বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমকে সদস্য সচিবকে করে টিম গঠন করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যৌথসভায় তারাও সবাই উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় অন্য নেতারাও।
আরও পড়ুন- ‘আ.লীগে আমি অপরিহার্য— এই আত্মপ্রসাদে ভুগবেন না’
সভায় উপস্থিত জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যে নারায়গঞ্জে দলের দুই প্রভাবশালী গ্রুপের দ্বন্দ্ব-বিভেদের চিত্র ফুটে ওঠে। জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের দূর্গ। কিন্তু নিজেদের মধ্যে বিভেদ থাকার কারণে বিএনপি-জামায়াত সুযোগ নেয়। এবার সিটি করপোরেশনে নির্বাচনে শামীম ওসমানকে সরাসরি মাঠে চান তারা। নির্বাচনি আচারণবিধির কারণে তিনি প্রত্যক্ষভাবে মাঠে থাকতে না পারলেও আইভীর নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার জন্য তার প্রত্যক্ষ সমর্থন জরুরি বলে মত তাদের।
জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের মধ্যেই নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, নারায়ণগঞ্জ সবসময়ই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এখানে আপনারা কেন নৌকার বিজয় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন? আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ নৌকাকে হারাতে পারবে না।
ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, আমি সবসময় জেলা আওয়ামী লীগের সব সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম। আজ যারা আমার সঙ্গে নৌকা চেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে খোকন কাকা, বাদল ভাই, চন্দন শীল দাদা আমরা প্রত্যেকে কিন্তু একসঙ্গে মিলে কাজ করেছি জেলা আওয়ামী লীগ ও নগর আওয়ামী লীগের জন্য। আমাদের মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই ২০০৯ সালের পর থেকে আমাদের মধ্যে একটু দূরত্ব তৈরি হয়। সেটি হতেই পারে, বিভিন্ন কারণে হয়েছে। কিন্তু কখনো আমি কারও বিপক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। আমি নেত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী আমার মতো করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার কাজ করেছি।
আরও পড়ুন- নানককে শেখ হাসিনার ফোন, নাসিক জয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান
আইভী আরও বলেন, ২০১১ সালে যখন সিটি করপোরেশন হলো, নেত্রীর দোয়া নিয়ে প্রার্থী হয়েছি। তার দোয়া ছিল এবং ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন হয়েছিল বলেই আজ এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি। তখনো অনেকেই আমার পক্ষে-বিপক্ষে ছিলাম। কিন্তু জয়ী হওয়ার পর সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। আমি দলের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার শেষ ঠিকানা আওয়ামী লীগ।
২০১১ সালে সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম নাসিক মেয়র নির্বাচিত হন। সে বছরই সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান শামীম ওসমান। তখন থেকেই মূলত বিভেদের শুরু। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো টিভি টক শোতে বসে দু’জন দু’জনকে দেখে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। এবার নারায়াণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেই বিরোধ আবার সামনে আসে। নৌকার টিকিট পেতে শামীম ওসমানের অনুসারীরা মনোনয়ন ফরম তোলেন।
সোমবারের সভায় উপস্থিত অধিকাংশ নেতাই বলেন, নারায়ণগঞ্জে চরম বিভেদ তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে তারা বলেন, আপনারা আজ আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে দেন। আমরা নৌকাকে বিজয়ী করব।
আরও পড়ুন- নারায়ণগঞ্জ সিটির ভোট ১৬ জানুয়ারি
পরে পরিস্থিতি বুঝে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভিডিও কলে সংযুক্ত করেন। ভিডিও কলে যুক্ত হয়ে শেখ হাসিনা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে নাসিকে নৌকার প্রার্থীকে জয়ী করার নির্দেশনা দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, নেতাকর্মী সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এখানে কোনো ভেদাভেদ চাই না। একটাই কথা— নৌকাকে জেতাতে হবে। হয়তো কারও পছন্দ আছে, কারও পছন্দ নেই। কিন্তু মনোনয়ন তো একজনই পাবেন। আমরা এক জনকেই মনোনয়ন দিয়েছি। তাকে নৌকার প্রার্থী মেনে নিয়েই তার পক্ষে কাজ করতে হবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার একটি কল, পরে ভিডিও কলে মতবিনিময় সভায় নেতাদের মাঝে ডিজিটাল উপস্থিতি বা ভার্চুয়াল নির্দেশনাই বদলে দেয় মতবিনিময় সভার চিত্র। এ বিষয়ে মির্জা আজম বলেন, আমাদের সংশয় ও ভয় ছিল। নারায়ণগঞ্জ নিয়ে বসব, কাল আবার গণমাধ্যমে নেতিবাচক কোনো বড় হেডলাইন হয় কি না! কিন্তু আজ সফলভাবে একটি সভা শেষ করায় সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
পরে মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন প্রার্থী আইভীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতির বিভক্তি নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে আইভী বলেন, আমাদের মধ্যে ওইরকমবিভক্তি নেই। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। কিন্তু আমরা ইলেকশনে একসঙ্গেই কাজ করেছি। অতীতেও এটা দেখা গিয়েছে। এবারের নির্বাচনেও দেখা যাবে।
শামীম ওসমান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইভী বলেন, উনি তো নৌকার লোক। উনি তো নৌকার বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারেন না। উনি আমাদের দলের নেতা। উনি জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী। উনি অবশ্যই নৌকার জন্য কাজ করবেন।
বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। কিন্তু বিএনপির একটি অংশ আইভীকেই সমর্থন করছেন বলে জল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে আইভী বলেন, এটা এভাবে বলা যাবে না। আমি মেয়র হিসেবে নারায়ণগঞ্জের সব মানুষের জন্যেই কাজ করছি। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করেছি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অবশ্যই তারা সেটা দেখবে। আশা করি সব জনগণ পক্ষে থাকবে এবং আমাকে নৌকায় ভোট দেবে।
মতবিনিময় সভা শেষে নাসিক নির্বাচন পরিচালনা কেন্দ্রীয় কমিটর সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে একটি সমন্বয় কমিটি হয়েছে। সেই সমন্বয় কমিটির সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের যৌথ মতবিনিময় সভা ছিল। নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে যে বিষয়গুলো আলোচনা দরকার, আমরা সেই বিষয়গুলো আলোচনা করেছি। আগামী ২৪ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় নারায়ণগঞ্জে শেখ রাসেল শিশু পার্কে এক যৌথ কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই কর্মীসভায় নারায়ণগঞ্জের যে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি হবে, সেই কমিটি কাজ শুরু করবে।
নানক আরও বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সবার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন। তিনি সংযুক্ত হয়ে আমাদের প্রার্থীকে আবারও দোয়া করে দিয়েছেন এবং সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে বিজয়কে সুনিশ্চিত করার জন্য নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর
ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নাসিক নির্বাচন নৌকার প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী