সমন্বয় হচ্ছে রাজধানীর ‘কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা’য়
২১ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:৫৮
ঢাকা: রাজধানীর কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় সমন্বয় করা হচ্ছে। এজন্য ‘মিডটার্ম রিভিউ অ্যান্ড আপডেডিটং অব স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোট প্ল্যান ফর ঢাকা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে বিদ্যমান সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা এবং নগর পরিবহন কর্মপন্থা পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করা হবে।
এছাড়া ভিত্তিমূল উপাত্ত হালনাগাদ করে ট্রাফিক চাহিদা পূর্বাভাস পুনর্নির্ধারণ হবে। সেই সঙ্গে ভ্রমণ চাহিদা ঠিক করতে জলযান পরিবহন, রেল এবং মালামাল পরিবহনকে অন্তভুর্ক্ত করে হালনাগাদ ঢাকা মহানগরীর সম্ভাব্য গণরিবহন করিডোর পুনঃপর্যালোচনা ও চিহিৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ থেকে ২৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। গত ১৫ ডিসেম্বর প্রস্তাবিত প্রকল্পটি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) সভা। ওই সভার কার্যবিবরণী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হচ্ছে, হালনাগাদ করা গণপরিবহন করিডোরগুলোতে ট্রানজিট উদ্ভূত ট্রাফিক উন্নয়নের সম্ভাবতা ঠিক করা হবে। এছাড়া স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার প্রকল্প তালিকা সংশোধন এবং সেগুলোর অর্থায়ন কাঠামো নিরুপনসহ বাস্তবায়ন কর্মসূচি হালনাগাদ করা হবে।
প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মামুন আল রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। এটি হলে পরিকল্পনা অনুযায়ী যেসব প্রকল্পে কাজ চলছে সেগুলো বাস্তবায়ন শেষ হলে রাজধানীর যানজট অনেকাংশে কমে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান সময়ের সঙ্গে সমন্বয় করানো হলে বাস্তবতার সঙ্গে মেলানো যায় না। তাই এটি সমন্বয় করার উদ্যোগটিতে সম্মতি দেওয়া হয়েছে।’
পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো কাগজপত্র থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। যার উৎপাদনশীলতা দেশের মোট জিডিপির শতকরা ৩৫ ভাগ। ১৯৯০ সালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল ৬৬ লাখ। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতিশীলতা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কারণে ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী এ শহরের জনসংখ্যা হয়েছে ২ কোটিরও বেশী। বর্তমানে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা মহানগরীর বর্তমান জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ৪৯ হাজার ৮০৩, যা পৃথিবীর অন্যান্য শহরগুলির তুলনায় অনেক বেশি।
লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এ মহানগরীর পরিবহনের সংখ্যাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০১ সালে ঢাকা শহরে নিবন্ধিত পরিবহন ছিল ২০ হাজার ৬০০, যা ২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১১ লাখ ১৫ হাজার ৬৫৪তে উন্নীত হয়েছে। সময়ের প্রেক্ষপটে ঢাকা মহানগরীর যানজট ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। ফলে কর্মঘণ্টার অপচয়, জ্বালানিসহ যানবাহনের অতিরিক্ত রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ও অন্যান্য কারণে বছরে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক ক্ষতিসাধিত হচ্ছে।
ঢাকা মহানগরীর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য একটি পরিকল্পিত ও সমন্বিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং এবং মহানগরীর অভ্যন্তরীণ সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন, নগরীরর প্রবেশ ও নির্গমন মহাসড়কের যানজট নিরসন ও আধুনিক গুপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য ২০০৫ সালে ২০ বছর মেয়াদী কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই এসটিপি হালনাগাদ ও সংশোধন করে ২০১৫ সাল হতে ২০৩৫ সালে বাস্তবায়নের জন্য সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। যা ২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ সভায় অনুমোদিত হয়।
‘আরএসটিপি’র তথ্য অনুযায়ী ঢাকা মহানগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩০ মিলিয়ন ট্রিপ তৈরি হয়। যা ২০২৫ সালে ৪২ মিলিয়ন এবং ২০৩৫ সালে ৫২ মিলিয়ন ট্রিপে উন্নীত হবে। এ বিশাল পরিবহন চাহিদা নিরসনে আরএসটিপিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আরএসটিপির আওতায় ২০৩৫ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ৫টি ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি), ২টি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে ৩টি রিং রোড, ৮টি রেডিয়াল সড়ক, ৬টি এক্সপ্রেসওয়ে, ২১টি ট্রান্সপোর্টেশন হাব নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, ট্রাফিক সেফটি ব্যবস্থা উন্নয়ন ও বাস পরিবহন ব্যবস্থা পুনর্গঠন করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়া আরএসটিপিতে ঢাকা মহানগরীকে কেন্দ্র করে চতুর্দিকের আঞ্চলিক উপশহর এলাকা গুলোকে সংযোগকারী অত্যধিক যাত্রী চাহিদাসম্পন্ন ছয়টি গণপরিবহন করিডোর চিহিৃত করা হয়েছে। এগুলো হলো- টঙ্গী-গাজীপুর করিডোর, পূর্বাচল করিডোর, নারায়ণগঞ্জ করিডোর, ঝিলমিল করিডোর, সাভার করিডোর এবং আশুলিয়া করিডোর। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় প্রতি ৫ বছর পরপর আরএসটিপির মধ্যবর্তী পর্যালোচনা ও পুনঃমুল্যায়নের বিধান রাখা হয়েছে।
আরএসটিপিতে ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের এলাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়নের ৫ বছরের মধ্যে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ফুটে উঠতে শুরু করে। এছাড়া ২০১৬ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নতুনভাবে ৮টি করে মোট ১৬টি ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিধি ৮২.৩৬ বর্গ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ১১৪.৫৬ বর্গ কিলোমিটার এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিধি ৪৫ বর্গ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ৬৪.১৭ বর্গ কিলোমিটার হয়েছে। মহানগরীর পরিধি বৃদ্ধিতে নগরীতে নতুনভাবে অন্তভুক্ত জনগনের পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করে বিদ্যমান আরএসটিপি পুনঃপর্যালোচনা সংশোধন হালনাগাদ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের মতামত হিসেবে এসপিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় মোট ২৫ কোটি ৪ লাখ ২২ হাজার টাকা বিভিন্ন পরামর্শক খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এরমধ্যে কনসালটেন্সি সার্ভিসেস ফর মিড-টার্ম রিভিউ অ্যান্ড আপডেটিং অব স্ট্রাট্রেজিং ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান খাতে ২০ কোটি ৭৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে পরামর্শক সেবার প্রয়োজনীয়তা, ধরণ, কর্মপরিধি, ডেলিভার করার সময়সীমা, রিপোর্টিং সিস্টেম ইত্যাদিসহ এ খাতের ব্যয় প্রাক্কলেনর ভিত্তি নিয়ে সভায় আলোচনা করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় গবেষণা কার্যক্রম এবং জরিপ কাজের জন্য দু’টি খাতে থোক হিসেবে যথাক্রমে ৫০ লাখ টাকা এবং ২৫ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় কি ধরনের গবেষণা ও জরিপ কিভাবে করা হবে তাসহ এ খাতগুলোর বিস্তারিত ব্যয় বিভাজন নিয়েও আলোচনা হয়। প্রশিক্ষণ খাতে মোট ৬৪ লাখ ২১ হাজার টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের ধরণ ও মেয়াদ এবং প্রশিক্ষণার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতি এবং সংখ্যা নির্ধারণের বিষয়ে সভায় জানতে চাওয়া হয়।
এছাড়া প্রকল্পের আওতায় একটি জিপ, ২টি পিক আপ এবং একটি মোটরসাইকেল কিনতে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। এরপরও কিন্তু ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি মাইক্রোবাস ভাড়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে। কারিগরি সহায়তা প্রকল্পে ৪টি গাড়ি কেনা ও গাড়ি ভাড়ার প্রস্তাবে যৌক্তিকতা নিয়ে সভায় প্রশ্ন তোলা হয়।
পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পিআইইউ এর জন্য আউটসোসিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। আউটসোসিংয়ের প্রয়োজনীয়তাও এক্ষেত্রে অর্থবিভাগের জনবল সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদনের বিষয়ে সভায় জানতে চাওয়া হয়।
সারাবাংলা/জেজে/এমও