যুদ্ধবিরতি শেষে পাকিস্তানে হামলা বাড়িয়েছে তালেবান
২১ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৫৬
জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), সাধারণভাবে পাকিস্তানি তালেবান নামে পরিচিত। গত ৯ ডিসেম্বর এক মাসব্যাপী যুদ্ধবিরতি সমাপ্ত ঘোষণার পর পাকিস্তানে ফের সন্ত্রাসী হামলা শুরু করেছে তারা। শীর্ষ টিটিপি নেতাদের কারামুক্তিসহ নানা প্রতিশ্রুতি পূরণে পাকিস্তান সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠীটি।
আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান পাকিস্তান সরকার ও টিটিপির মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিল। এর আগে পাকিস্তানের অন্যতম ভয়ংকর জঙ্গিগোষ্ঠী টিটিপি সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে লাগাতার হামলা চালিয়ে আসছিল।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের একীভূতকরণের মাধ্যমে গঠিত হয় তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। আদর্শগতভাবে তারা আফগান তালেবানের সঙ্গে যুক্ত এবং ইসলামী আইন অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে রয়েছে তাদেরও। ২০১৪ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভিযানে কোণঠাসা হয়ে সীমান্তের ওপারে আফগানিস্তানে গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছিল টিটিপি।
এই অঞ্চলে বিদ্রোহ পর্যবেক্ষণকারী বিশ্লেষকরা মনে করে, আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয় এবং দেশটি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার টিটিপিকে আরও উৎসাহিত করেছে এবং মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে।
নিরাপত্তা বিষয়ক ইসলামাবাদভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক পাক ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের সংকলিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে টিটিপি ৯৫টি হামলা চালিয়েছে, এতে নিহত হয়েছেন ১৪০ জন। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে ৪৪টি হামলা চালিয়েছে টিটিপি। ১৪ জুলাই একটি আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে পাকিস্তানের কোহিস্তান জেলায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত নয় জন চীনা প্রকৌশলীকে হত্যা করে টিটিপি।
গত আগস্টে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল তালেবানের হাতে পতনের পর ওই মাসেই টিটিপি ৩২টি, সেপ্টেম্বরে ৩৭টি এবং অক্টোবরে ২৪টি হামলা চালায়। এসব হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় টিটিপি।
সেসময় পাকিস্তানের শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারা তালেবানকে আফগানিস্তানে টিটিপির অবাধ বিচরণ বন্ধ করার তাগিদ দেন। পরবর্তীতে আফগান তালেবানরা টিটিপি ও ইসলামাবাদের মধ্যে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করে। যার ফলে দুই পক্ষের মধ্যে এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়।
তবে মাত্র এক মাস যুদ্ধবিরতির পর গত ৯ ডিসেম্বর টিটিপি তা সমাপ্ত ঘোষণা করে। পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর আবার হামলা শুরু করে তারা। ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক অডিও বার্তায় টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি দাবি করেন, ‘আলোচনার সময় টিটিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কারামুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার, কিন্তু যুদ্ধবিরতির এক মাস পার হলেও তাদের মুক্তি দেওয়া হয়নি।’
যুদ্ধবিরতি সমাপ্ত ঘোষণার পর এ পর্যন্ত অন্তত ১০টি হামলার দায় স্বীকার করেছে টিটিপি। পাকিস্তানের নানা প্রান্তে নিরাপত্তাবাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যাও করেছে তারা। সর্বশেষ ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে গত ১৬ ডিসেম্বর খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের লাকি মারওয়াত জেলায় একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে হত্যা। এছাড়া ১৪ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সেনা সদর দফতরসহ একটি পুলিশ দলের উপর হামলা।
সরকার-টিটিপি আলোচনায় অংশ নেওয়া ইসলামবাদের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা জাপানের সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়াকে জানান, টিটিপির বেশিরভাগ দাবি মেনে নেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সরকার আফগানিস্তানে ক্ষমতায় থাকা তালেবানদের বলেছে, তারা যেণ প্রভাব কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপি জঙ্গিদের নিবৃত্ত করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, ‘টিটিপি নিজেদের আফগান তালেবানদের সমকক্ষ মনে করছে। তারা দাবি করছে, মুসলিম খান ও লতিফ মেহশুদের মতো শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের মুক্তি দিয়ে সীমান্তবর্তী জেলায় পাঠাতে। এছাড়া তৃতীয় একটি দেশ যেমন কাতারে আলোচনার প্রস্তাবও দিচ্ছে তারা। টিটিপি আফগান তালেবানদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করছে।’
উল্লেখ্য যে, কয়েক ডজন পাকিস্তানিকে হত্যা ও ২ চীনা নাগরিককে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে শীর্ষ টিটিপি নেতার মৃত্যুদণ্ড দেয় পাকিস্তানের সামরিক আদালত। এছাড়া ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে আটক শীর্ষ টিটিপি নেতা মেহশুদকে পাকিস্তানে হস্তান্তর করে মার্কিন বাহিনী। পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী এসব জঙ্গিনেতাদের ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী চৌধুরী ফাওয়াদ হুসেন ১৩ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘সংবিধান ও আইনের প্রতি সম্মান না দেখালে টিটিপির বিরুদ্ধে ফের লড়াই করতে প্রস্তুত সরকার।’
এদিকে আফগান তালেবানরা পাকিস্তান সরকার ও টিটিপি জঙ্গিদের মধ্যে সুসম্পর্ক চাইছে। আফগানিস্তানে সরকার গড়া তালেবানদের দরকার পাকিস্তানের সমর্থন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। গত ১১ ডিসেম্বর আফগান তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ টিটিপিকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার তাগিদ দেন। একই সঙ্গে তিনি পাকিস্তান সরকারকে দেশ ও গোটা অঞ্চলের স্বার্থে টিটিপির দাবিদাওয়াগুলো বিবেচনার অনুরোধ করেন।
অতীতে পাকিস্তান সরকার টিটিপি ও অন্যান্য পাকিস্তানি তালেবান গোষ্ঠীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি সমঝোতা চুক্তি করলেও এর কোনোটাই কয়েক মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি।
সিঙ্গাপুরের নানয়াং টেকনোলজিক্যাল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের ফেলো আব্দুল বাসিত নিক্কেই এশিয়াকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘অতীতের চুক্তিগুলোর মতোই এবারও যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে টিটিপি উৎসাহ, গতি ও বৈধতা পেয়েছে। তারা এখন নিজেকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে নিজেদের চিত্রিত করেছে।’
আব্দুল বাসিত বলেন, ‘২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পেশোয়ারে টিটিপি জঙ্গিরা দেড়শর বেশি স্কুল শিক্ষার্থীকে হত্যা করার পর ২০১৫ সালের জুনে পাকিস্তান সরকার সন্ত্রাসবিরোধী নীতি গ্রহণ করেছিল। শান্তি আলোচনায় সাম্প্রতিক ব্যর্থতা জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যমত্যকে দুর্বল করেছে।’
-নিক্কেই এশিয়া অবলম্বনে
সারাবাংলা/আইই