ঝুঁকিপূর্ণদের সুরক্ষা দিয়েই মহামারিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ
২১ ডিসেম্বর ২০২১ ২২:১৩
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশও। দেশের সব অঞ্চলের সব শ্রেণিপেশার মানুষের ওপরই পড়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। তবে যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ছিল, সেই প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার কারণেই করোনার অভিঘাতের প্রভাব বাংলাদেশে তীব্র হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলছেন, বাংলাদেশও করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশগুলোর একটি হতে পারত। কিন্তু আমরা আমাদের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য দ্রুত সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি। আমরা ঝুঁকিতে থাকা ব্যবসাগুলোর সুরক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছি। ফলে করোনার অভিঘাত আমাদের অন্যান্য দেশের মতো এত বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। এখন মহামারি থেকে দ্রুতই উত্তরণ ঘটছে আমাদের। এক দশক আগে আমাদের অর্থনৈতিক উত্থানের যে সূচনা, বর্তমানে মহামারি কাটিয়ে ফের সেই ধারাবাহিকতায় ফিরে আসার মতো অবস্থানে পৌঁছেছি।
নিউইয়র্কভিত্তিক জনপ্রিয় সাময়িকী ফরচুনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। সোমবার (২০ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর তার নিবন্ধে লিখেছেন, কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের প্রচেষ্টা ছিল জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় করা। আমাদের লক্ষ্য ছিল প্রথমেই জনগণের চাহিদা পূরণ করা এবং এরপর মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ব্যবসাগুলোর জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, গত বছর মহামারির শুরুতে সরকার হত-দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, বয়োজ্যেষ্ঠ, অভিবাসীসহ নিঃস-অসহায় নারীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছে। আমরা খুব দ্রুতই চার কোটি বা দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষের কাছে নগদ অর্থ সহায়তা পৌঁছে দিতে সমর্থ হই। সব মিলিয়ে আমরা ২৮টি আলাদা আলাদা প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় মোট ২ হাজার ২১০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছি। এই অর্থ আমাদের দেশের জিডিপি’র প্রায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এর বাইরেও আমরা করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভ্যাকসিন ও অন্যান্য জরুরি ব্যবস্থা নিতে আরও কয়েকশ কোটি ডলার খরচ করেছি।
করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওমিক্রনের কারণে যে ধরনের পরিস্থিতিই আসুক না কেন, সবসময় আমাদের সব ধরনের পদক্ষেপের কেন্দ্রবিন্দু হলো জনগণ। কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না— সরকার এই নীতি অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এর আওতায় দেশের ১ কোটি ৬৮ লাখ মানুষকে চাল, শিশুখাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আমরা বয়স্ক ও অক্ষম নাগরিক এবং নিঃস্ব ও অসহায় নারীদের কাছেও এই সহায়তা পৌঁছেছি। এছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি শুরুর আগেই আমার বাবা ও এ দেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী সামনে রেখে ঘরহীন নাগরিকদের জন্য ঘর নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলাম। এই উদ্যোগ মহামারিকে বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় ধরনের অবদান রেখেছে।
ক্ষুদ্র ব্যবসা ও এসব ব্যবসায় নিয়োজিতরা সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা লিখেছেন, সরকার তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা, বিশেষ করে নারী ও কৃষকদের জন্য সরকার সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছে। করোনার অভিঘাতে বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যটন শিল্প খাতের কর্মীদেরও বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্যও সরকার এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়েছে।
বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান লিখেছেন, তৈরি পোশাক খাতের মতো রফতানিমুখী খাতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে আমরা কয়েকশ কোটি ডলার প্রণোদনা দিয়েছি। উৎপাদন খাতে নিয়োজিত বড় বড় কোম্পানি এবং তথ্যপ্রযুক্তির মতো ক্রমবর্ধমান সেবাখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও সরকার মূলধনের ব্যবস্থা করেছে। এসব প্রণোদনার অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার সুদের একাংশ সরকারও বহন করেছে। শুধু তাই নয়, কর্মীদের ওপর থেকে আর্থিক চাপ কমাতে গত বছরে প্রথমে দুই মাসের জন্য এবং এরপর পরবর্তী ১২ মাসের জন্য এই ঋণের সব সুদ মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে।
মহামারি প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা লিখেছেন, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সামাজিক দূরত্ব অনুসরণের বিধান চালু করা হয়। সবার মাস্ক পরাও বাধ্যতামূলক করা হয়। পাশাপাশি গত বছরের মার্চের শেষ ভাগ থেকে জুন পর্যন্ত ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ওই সময় শিল্পোৎপাদন কমেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো রীতিমতো বন্ধ হয়ে যায়। বৈশ্বিক লকডাউনের জন্য ওই সময় সারাবিশ্বেই চাহিদা কমে যায় এবং এর প্রভাবে আমাদের অর্থনীতির ভিতও নড়ে যায়। কিন্তু আমরা কখনো নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারাইনি এবং আমরা আমাদের জনগণের জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছি। আমরা সারাদেশে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা চালু করেছি। আমরা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত (কন্টাক্ট ট্রেসিং) করেছি। আমরা দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন সুবিধা চালু করেছি। শুধু তাই নয়, আমরা চিকিৎসাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে ৬ হাজার ২০০ জন চিকিৎসক, ১০ হাজার নার্স এবং ৩ হাজার গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিয়েছি। আর প্রান্তিক পর্যায়ে বছরের পর বছর বিনিয়োগের কল্যাণেই এই ভয়ংকর চাপের মধ্যেও আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত যথেষ্ট দৃঢ়তা দেখাতে সক্ষম হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নিবন্ধে লিখেছেন, পুরনো বিনিয়োগের পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্যোগ অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে এবং আমাদের অর্থনীতিকেও প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষম করেছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ২ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বের পাঁচটি দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির একটি। গত ১০ বছরে আমরা দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। মাত্র এক দশকেই আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। এখন দেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ২ হাজার ২২৭ ডলার, যা প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের সীমা অতিক্রম করেছে। করোনা মহামারি আমাদের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করতে পারেনি।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীই সরকারের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বলে নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রকৃত অর্থেই যাদের সহায়তা বেশি প্রয়োজন ছিল, তাদের প্রতি আমাদের মনোযোগও ছিল বেশি। আর তার সুফলও শিলছে। আমরা বিশেষভাবে গর্বিত যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমাদের সপ্তম স্থান দিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকেই এই সূচকে আমরা আঞ্চলিক প্রতিবেশী সব দেশকে পেছনে ফেলেছি। আমরা শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭-এ নামিয়ে আনতে পেরেছি। মাতৃমৃত্যুর হার কমে লাখে ১৭৩ এ-নেমে এসেছে। আমাদের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর।
ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দেশের অগ্রগামিতার তথ্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির আত্মীকরণ ও এ খাতের সফল প্রয়োগেও বাংলাদেশ আজ বিশ্বে নেতৃত্বস্থানীয়। আমাদের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটিয়েছে, অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য এনেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবিলাকেও সহজ করেছে, যা ডিজিটাল প্রযুক্তি না থাকলে এত সহজ হতো না। এখন দেশের প্রায় সব মানুষই স্মার্টফোনের ওপর নির্ভর করে। ফলে মহামারির হালনাগাদ তথ্যগুলোও তারা প্রতি মুহূর্তেই পেয়ে যাচ্ছে।
স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্য। এ প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময় বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটি দেশ। এরপর আমরা অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি। এ বছরে এসে আমরা শেষ পর্যন্ত নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের সম্মান অর্জন করেছি। ২০২৬ সালের মধ্যে আমরা জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছি। শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বৈশ্বিক মহামারির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও এসব অর্জন আর অসম্ভব নয়। মানুষের জন্য কাজ করাই প্রকৃতপক্ষে সব পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।
সারাবাংলা/টিআর
করোনা মহামারি করোনার অভিঘাত কোভিড-১৯ প্রণোদনা প্যাকেজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর নিবন্ধ ফরচুন সাময়িকী