বিবাহিত ছাত্রীদের আবাসন, হুট করে নীতি পরিবর্তন চায় না ঢাবি
২২ ডিসেম্বর ২০২১ ১৪:৩৫
ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে বিবাহিত ও অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষার্থীরা থাকতে পারবেন না—এমন একটি নীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
ছাত্রীদের একটি অংশ বলছেন, এ নীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, পরিবর্তন আবশ্যক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোও এই নীতির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, হুট করে এটি পরিবর্তন সম্ভব নয়। এর সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যুক্ত আছে। তা ছাড়া এ নীতি হুট করে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত বিবাহিত নারী শিক্ষার্থী বৃদ্ধির পক্ষে উৎসাহমূলক হবে কি না—সে প্রশ্নও তুলেছেন একটি ছাত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বমোট পাঁচটি হল আছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে বিবাহিত দুই ছাত্রীর সিট নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
আবাসিক ছাত্রীদের সিট বণ্টন সম্পর্কিত ও অন্যান্য শৃঙ্খলামূলক নিয়মাবলীর একটি অংশে উল্লেখ আছে—‘কোনো ছাত্রী বিবাহিত হলে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষকে জানাবে। অন্যথায় নিয়ম ভঙ্গের কারণে তার সিট বাতিল হবে। শুধুমাত্র বিশেষ ক্ষেত্রে, বিবাহিত ছাত্রীকে চলতি সেশনে হলে থেকে অধ্যয়নের সুযোগ দেয়া হবে। অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রী হলে থাকতে পারবে না।’
গেল সপ্তাহে এই নিয়মটি বাতিলসহ মোট চারদফা দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে স্মারকলিপি প্রদান করেন কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘উপবৃত্তিসহ মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করাত নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। নানা জায়গা থেকে মেয়েরা পড়াশোনা করতে আসে। তাই তাদের জন্য এ সব নিয়ম যুগোপযোগী করতে হবে। ছেলে ও মেয়েদের হলে আলাদা নিয়ম থাকা যাবে না। উভয়কে সমান সুযোগ দিতে হবে।’
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা মনে করেন, বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকা বা না থাকা নিয়ে যে আলোচনা, তা কোনো ইস্যুই নয়।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা কি কোনো ইস্যু? ইস্যু বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এগুলো পরিবর্তন করার তো কী এমন ঘটেছে?’
এ ধরনের আলোচনা বিবাহিত নারী শিক্ষার্থী বৃদ্ধির পক্ষে উৎসাহব্যঞ্জক হবে কি না—সেই প্রশ্নটিও সামনে নিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি একটি অনাহূত বিতর্ক, অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক। সার্বিকভাবে এটি একটি গঠনতান্ত্রিক বিষয়, এর সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক অনেক বিষয় আছে। সেগুলোর চুল চেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ এখানে বহু মেয়ে বিয়ের বিরুদ্ধে ফাইট করে পড়তে আসে। বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিতে চায়। ১৮/১৯ বয়সী মেয়েদের বিয়ে করতে উৎসাহিত করবো কি না—এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। আপনারা যে প্রশ্ন তুলেছেন, এর মধ্য দিয়ে আরও একটি মৌলিক জায়গা চলে আসে যে, যেসব মেয়েরে বিয়ের চাপ উপেক্ষা করে পড়তে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে যাওয়া হচ্ছে কি না?’
অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, ‘আমাদের মতো দেশে শিক্ষা ও বিয়ের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক আছে।’
আরও পড়ুন: বিবাহিত ছাত্রীদের ঢাবির হলে না থাকার বিধি বাতিল চেয়ে নোটিশ
তিনি বলেন, ‘কোনো ছাত্র বা ছাত্রী হলে বিবাহিতদের থাকার কোনো অবস্থা নেই। এটির অনেক ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক কারণ আছে। বিশেষত, আমাদের মতো দেশে শিক্ষা ও বিয়ের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক আছে। ১৮/১৯ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাক কিংবা এটিকে উৎসাহিত করে এমন কাজ হোক, তা তো আমরা চাই না। এতে করে তো বাল্যবিবাহ আরও উৎসাহিত হবে। তাই, হুটহাট করে সবকিছু পরিবর্তন করে বিবাহিত ছাত্রী বাড়িয়ে দিতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে কি না—এটা নিয়ে আমার মনে হয় আরও ভাবা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘যখনই একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়, তখনই তার ওপর নানা ধরনের চাপ আসে। তাকে সন্তান গ্রহণে চাপ দেওয়া হয়। শ্বশুরবাড়িতে থাকার জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমি চাচ্ছি না যে, পড়াশোনা করা অবস্থায় বিবাহিত মেয়ের সংখ্যা আরও বেড়ে যাক। যখনই দেখা যাবে, এরকম কিছু একটা আমরা সংশোধন করে দেব, অনেক বাবা-মা বলবে—অসুবিধা নেই, এখন তো বিয়ে করলেও সমস্যা হবে না, পড়াশোনা চালাতে পারবে। আমি এই আগাম সতর্কবার্তা আপনাদের দিতে চাই।’
ছাত্রসংগঠনগুলো যা বলছে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো এ নিয়মের বিরোধিতা করেছেন। পাশাপাশি এই নিয়ম বাতিলেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘বিবাহিত হওয়ার কারণে কেউ হলে থাকতে পারবে না- এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক একটি সিদ্ধান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার প্রথম পরিচয় হচ্ছে শিক্ষার্থী। নাগরিক হিসেবে কে বিবাহিত, কে অবিবাহিত বা অন্য কোনো পরিচয়ে আবদ্ধ কিনা, এটি দেখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এই নিয়ম প্রত্যাহার করার জন্য বলেছি।’
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাগিব নাঈম বলেন, ‘এটি আসলেই একটা উদ্ভট সিদ্ধান্ত। আমরা অলরেডি প্রশাসনকে এ বিষয়ে জানিয়েছি। এই নিয়ম বাতিল করতে হবে।’
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবু রায়হান বলেন, ‘প্রশাসনের কাছে আমরা দাবি জানিয়েছি। নারী শিক্ষার অগ্রগতির পথে বাধা এই নিয়মসহ বাকি নিয়মগুলোও বাতিল করতে হবে।’
অন্য একটি বিকল্প
বিবাহিত নারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে একটি বিকল্পের কথাও জানিয়েছেন রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদা। বিবাহিতদের জন্য ভবনের আলাদা একটি অংশ বরাদ্দ দেওয়া কিংবা ছোটো ডর্ম বা হোস্টেলের মতো বানিয়ে দিয়ে বিকল্প তৈরি করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন তিনি।
সারাবাংলাকে অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, ‘এর বিকল্প হিসেবে আলাদা একটি জোন বা ছোটো ডর্ম করে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, বিবাহিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা তো খুবই কম। নরমাল সিচুয়েশনে তো দুইজন না তিনজন পাই আমরা। সে হিসেবে, কোনো ভবনের আলাদা একটা অংশ তাদের জন্য থাকতে পারে কিংবা ছোটো একটা হোস্টেলের মতো করে দেওয়া যেতে পারে।’
বিতর্কিত নিয়মের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে আজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের হলে আসন বণ্টন সম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিয়মিত সভা ডেকেছে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি। বুধবার সন্ধ্যায় এ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে বলে একাধিক সূত্র সারবাংলাকে নিশ্চিত করেছে।
সারাবাংলা/আরআইআর/একে